শিলিগুড়ি থেকে কাকরভিটা পানিট্যাঙ্কি, নেপাল সীমান্ত। সেখান থেকে বাস ধরে পোখরা পোখরা ভ্যালি। হোটেলে জিনিসপত্র রেখে প্রয়োজনীয় পারমিট সংগ্রহ করে হাল্কা মনে হাঁটা দিলাম পোখরার সৌন্দর্য দেখতে। মচ্ছপুছারে তখন ছায়া দিচ্ছে ফিউয়া তালের জলে। দু’-চারটে নৌকা লেকের জলে এ পার ও পার করছে। সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে...আকাশ তার ক্যানভাস মেলে ধরেছে। সূর্যাস্তের পর হোটেলে ফিরে খাওয়া শেষে বিশ্রাম। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে যে!
পর দিন সকালে যাত্রা শুরু। পোখরার সীমানা ছাড়িয়ে হাল্কা চড়াই বেয়ে পথ চলেছে। নয়াপুল, তিরকেধুঙ্গা পার হয়ে ঘোড়েপানি। প্রায় দশ ঘণ্টার এই পথে সঙ্গ দেবে মচ্ছপুছারে, অন্নপূর্ণা...নানা পাখির ডাক আর জঙ্গলের গন্ধ। রাতের বিশ্রাম সেরে পর দিন ভোর ভোর উঠুন। মনটাই ভাল হয়ে যাবে ধবলগিরি, তুকুচে, নীলগিরি, অন্নপূর্ণা আর মচ্ছপুছারের মাথায় প্রথম সূর্যের আবির খেলা দেখতে দেখতে। ভাললাগাটুকু মনে ধরে রাখতে রাখতে আবার সে দিনের হাঁটা শুরু।
পার হয়ে এলাম তাতোপানি, কালপানি, ঘাসা, মারফা, আরও কত জায়গা। চলার পথের শুরু থেকে তিনটে দিন পার হয়ে গেছে। পথে দানা গ্রামের গাছভর্তি কমলালেবু ডুবতে থাকা সূর্যের রং-এর সঙ্গে টক্কর দিয়েছে। পথের বাঁকে হঠাৎ করে দেখেছি ‘রুপসে’কে, রূপসী ঝর্না। তার রূপে মজে সময় ভুলেছি। কখনও দমফাটা চড়াই-এর পর পাহাড়ের গায়ে এক টুকরো চায়ের দোকানে বসে মন জুড়নো লেবু চায়ের স্বাদ নেওয়া, কখনও বা মসের ওড়নায় ঢাকা গাছের জঙ্গল ভেদ করে মার্কোপোলোর মতো আবিষ্কার আর এক গ্রাম। মারফা বিখ্যাত তার আপেলের জন্য। গ্রামের বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসছে ‘অ্যাপেল বিয়ার’-এর সুগন্ধ। বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা আপেল গাছেরা ফলবতী। হাসি ছলকে উঠছে তাদের গালে। পরের কোনও গ্রাম আবার সবুজ। প্রকৃতি কী আশ্চর্য ভাবে সাজিয়েছে গ্রামগুলোকে! মনের মাঝে অদ্ভুত এক পেলবতার মিলমিশ। পাঁচ দিনের হাঁটা শেষে প্রায় ১৮০ কিমি রাস্তা পার করে জোমসোম থেকে কাগবেণী হয়ে টেক্সাসের মরুভূমির মতো ল্যান্ডস্কেপের থোরাং লা উপত্যকার শেষে যখন মুক্তিনাথ এসে পৌঁছলাম তখন মন বলছে এই বোধহয়
মুক্তির আনন্দ, খেয়ালখুশিতে ভেসে চলা, জীবনের পথে কোনও হিসেব না কষে।
ফিরছি যখন...পথে জলছবি আঁকা হয়ে আছে, সোনারঙা বালি গণ্ডকির জলে ভেজা, শরৎ-নীল আকাশ, তাতে হেলান দিয়ে পাহাড়েরা, ধবলগিরির শুভ্রতা, গোলাপি আপেলের বাহারি বাগান, ক্লোরোফিল সবুজ জঙ্গলের মেদুরতা, হঠাৎ এসে পড়া কোনও গ্রামের দরজার ফাঁকে কোনও সুন্দরীর লাজুক মুখ, উদাস আকাশপানা চোখ নিয়ে দামাল হাওয়ার মতো ভেসে আসা ছোট্ট ছোট্ট আমাদের ছেলেবেলা...আমি পেরিয়ে যাচ্ছি মুক্তির আনন্দে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম। ক্যামেরা ছাড়াও মনের
হ্যান্ডিক্যামে প্রকৃতির ভিডিও তোলার ব্যস্ততা...ধরতে না ধরতেই হারিয়ে যায় যে! রূপসী লারজুং-এ রাতের বিশ্রাম। সন্ধ্যা নামছে। যে বাড়িতে আছি তার সামনে নদী, বুকের ভিতরে রাখা তিরতির করে কাঁপতে থাকা ভালবাসা নিয়ে বয়ে চলেছে। কী লাজুক! রাতের খাওয়া শেষে হাল্কা হিমেল হাওয়ায় নতুন ওঠা চাঁদকে সাক্ষী রেখে রাতপাখির ডাক শুনতে শুনতে বসলাম নাম-না-জানা সেই ভালবাসার পাশে তাকে আমার করে নিতে। কত ক্ষণ কত যে গল্প করেছিলাম তার সঙ্গে কে জানে! হুঁশ ফিরল যখন মচ্ছপুছারে প্রথম সূর্যের আদর নিচ্ছে।
|
কী ভাবে যাবেন |
শিলিগুড়ি থেকে অটো বা গাড়িতে কাঁকরভিটা-পানিট্যাঙ্কি নেপাল সীমান্ত। সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে পোখরা। কাঠমান্ডু হয়েও পোখরা যাওয়া যায়। পোখরা থেকে হাঁটাপথে ন’ থেকে দশ দিনে মুক্তিনাথ যাওয়া-আসা। অথবা পোখরা থেকে ছোট প্লেন বা হেলিকপ্টারে জোমসোম নেমে সেখান থেকে এক দিনের হাঁটা পথে মুক্তিনাথ, কিংবা জোমসোম থেকে রানি পাওয়া হয়ে সওয়ারি হন কোনও মোটরবাইক চালকের পিছনে (ভাড়া পাওয়া যায়), ১৫-২০ মিনিটে মুক্তিনাথ। না হলে পোখরা থেকেই ল্যান্ডরোভারে ১০ ঘণ্টায় জোমসোম, সেখানে রাতটা থেকে পর দিন আরও আড়াই ঘণ্টায় রানিপাওয়া। রানিপাওয়া থেকে হাঁটলে মুক্তিনাথ ৪০ মিনিট, আর মোটরবাইকে ১৫ মিনিট। |
কখন যাবেন |
ভাল সময় ফেব্রুয়ারি থেকে মে এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর। |
কোথায় থাকবেন |
গোটা পথেই বেসরকারি লজ বা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা আছে। |
মনে রাখবেন |
শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা বা উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকলে না আসাই ভাল। প্রয়োজনীয় শীতের পোশাক রাখবেন। খাবার সব জায়গায় পাওয়া যায়। ওষুধ, টর্চ, টয়লেট পেপার সঙ্গে রাখুন। নেপালে প্রবেশ করার পর ভারতীয় মুদ্রা ভাঙিয়ে নিন নেপালি মুদ্রায়, যতটা প্রয়োজন। |
|
|
|