কে মাধবন! জনমানস এবং গুগল সার্চ! দুয়েতেই অনেক বেশি স্বীকৃত বোফর্স তদন্ত, রাজীব গাঁধী হত্যা অনুসন্ধান, ইউনিয়ন কারবাইড গ্যাস কেলেঙ্কারি জাতীয় মহাচাঞ্চল্যকর সব মামলায় তন্নিষ্ঠ গোয়েন্দাগিরির জন্য। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে অবশ্য তিনি প্রসিদ্ধ থেকে যাবেন ভারতীয় ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িত ক্রিকেটারদের সাজা দানের নেপথ্য নায়ক হিসেবে। সিবিআই-এর প্রাক্তন যুগ্ম ডিরেক্টর, অধুনা আইন ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়া মাধবন শুক্রবার সন্ধ্যায় স্পট ফিক্সিং রায় নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন তাঁর সাকেত-এর বাড়ি থেকে।
প্রশ্ন: লন্ডন আদালতের রায় শুনে কাল কী মনে হল? ক্রিকেটের শুভ দিন?
মাধবন: শুধু ক্রিকেট কেন, সব খেলার জন্য শুভ দিন। মঙ্গলময় দিন। ট্রেন্ডসেটার হয়ে রইল লন্ডন আদালতের এই রায়।
প্র: অনেকের মনে হচ্ছে আপনার রিপোর্টের ভিত্তিতে বিসিসিআই এত কিছু করল। কিন্তু ক্রিকেটারদের জেলে পাঠাতে পারল না। ইংল্যান্ড যা করে দেখিয়ে দিল, ভারতীয় উপমহাদেশ সেই একই সুযোগ এগারো বছর আগে পেয়েও ব্যর্থ হয়েছিল।
মাধবন: আমাদের কিছু করার ছিল না। আমাদের দেশে এই অপরাধের সাজা দেওয়ার মতো উপযুক্ত আইন নেই।
প্র: তারকা ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে কেমন অসহায় লেগেছিল?
মাধবন: তদন্তের সময় কখনও না। পরে লেগেছিল যখন বুঝলাম উপযুক্ত আইনের অভাব রয়েছে এ ক্ষেত্রে।
প্র: এদের পেট থেকে কথা বার করাটা সমস্যা হয়নি?
মাধবন: বরঞ্চ সহজ হয়েছিল। এরা তো সেই অর্থে জন্ম-অপরাধী নয়। টাকার লালসায় কাণ্ডটা ঘটিয়েছিল। সিবিআই-তে থাকাকালীন যে সব শ্রীমানকে দেখেছি তার তুলনায় এরা কিছুই না।
প্র: ইমরান খান বলেছেন ভবিষ্যতে ক্রিকেটারদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নিয়মিত ভাবে তল্লাশি চালানো উচিত। তাতে যদি অপরাধ প্রবণতা কমে!
মাধবন: প্র্যাক্টিক্যাল আইডিয়া নয়। এক জন তারকা ক্রিকেটার পৃথিবী জুড়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। ক্যানারি আইল্যান্ডে অনায়াসে খুলতে পারে। লুক্সেমবার্গে খুলতে পারে। সুইৎজারল্যান্ডে খুলতে পারে। আইসিসি ক’টা দেশ হাতড়ে বেড়াবে? সুইৎজারল্যান্ডে কোনও আয় বা বসতি না থেকেও স্রেফ পাসপোর্ট ব্যবহার করে লোকে দিব্যি অ্যাকাউন্ট
খুলে ফেলতে পারে। পরিচয়পত্র ঠিকঠাক থাকলে অ্যাকাউন্ট খোলাটা খুব সহজ আর আমি নিজে বোফর্স তদন্তে সুইৎজারল্যান্ড গিয়ে দেখেছি, সুইস অ্যাকাউন্ট কেউ খুলে ফেললে তার ভেতরকার ডিটেল বার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ক্রিকেটার কোথায় কত টাকা ফেলছে আপনি জানবেন কী করে? কে বলে দেবে আপনাকে যদি আপনি সরকারি অনুসন্ধানকারীও হন।
প্র: আর এক প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় পরামর্শ দিয়েছেন, সব আন্তর্জাতিক ম্যাচে চব্বিশ ঘণ্টা লাই ডিটেক্টর মেশিনের ব্যবস্থা হোক। ক্রিকেটারদের ফেলা হোক তার সামনে।
মাধবন: একমত নই। ক্রিকেট মানেই কি অসাধু নাকি? বরঞ্চ বেশির ভাগ ক্রিকেটারই সৎ। ইন্ডিয়ান টিমে যেমন আমি মুগ্ধ হয়ে রাহুল দ্রাবিড়কে দেখি। খুব ভদ্র। দেখলেই বোঝা যায় ভ্যালুজ আছে। এ কিছুতেই ফাঁদে পা দেওয়ার পাত্র নয়! কোনও দিন এ সব কাজ করবে না।
প্র: ফাঁদে পা দেওয়ার পাত্র কেউ আছে বলে মনে হয় এই ইন্ডিয়ান টিমে?
মাধবন: দু’তিন জন আছে। যারা শো-তে বিশ্বাস করে। বাড়তি রংচংয়ে বিশ্বাস করে। ভেতর থেকে এরা নিশ্চয়ই খারাপ না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি উল্টোপাল্টা চক্করে এই জাতীয় চরিত্রদের পড়ে যাওয়ার ভাগটা খুব বেশি থাকে।
প্র: কারা?
মাধবন: না, না। নো নেমস প্লিজ।
প্র: একটা কথা বলুন। এগারো বছর আগে আপনার যে তদন্তের ভিত্তিতে আজহার-রা দণ্ডিত হন, তখন অনুসন্ধান করতে গিয়ে কি বিস্মিত হতে হয়েছিল?
মাধবন: কীসের বিস্ময়!
প্র: এই যে সাধারণ মানুষের আইডলরা এমন দুর্নীতিতে জড়াতে পারে সেই বিস্ময়!
মাধবন: একটুও না। আমার সিবিআই জীবন দেখিয়েছে, স্টেটাসের সঙ্গে মানুষের লোভের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি দীনদরিদ্র পিওনকে দেখেছি আপাদমস্তক সৎ। আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে দেখেছি চোর। এটা যার যার ব্যক্তিগত নৈতিকতার প্রশ্ন।
আর একটা কথা মনে রাখতে হবে। আমি যখন ক্রিকেটারদের নিয়ে তদন্ত করেছিলাম তখন ইন্ডিয়া প্লেয়ারদের রোজগার অনেক কম ছিল। প্রলোভনটা হয়তো বেশি হয়ে তাদের সামনে দেখা দিত। সে সময় কীই বা রোজগার ছিল? আমি নিজে সরকারি চাকরি করেছি। হয়তো পদ হিসেবে খুব উঁচু। কিন্তু সংসার টানতে জান বেরিয়ে গিয়েছে। হ্যান্ড টু মাউথ এগজিসটেন্স।
প্র: সৌরভের সুপারিশটা পুরোটা আপনাকে বলা হল না। ওঁর সাজেশন, সবাইকে বাধ্যতামূলক ভাবে লাই ডিটেক্টরের সামনে ফেলো না। কিন্তু সন্দেহ হওয়া মাত্র যন্ত্রটাকে ব্যবহার করো।
মাধবন: হ্যাঁ, এই প্রস্তাবটা ভাল। কার্যকর করা যেতেই পারে।
প্র: এই যে ভয়ঙ্কর শাস্তি হল এর ফলে স্পট ফিক্সিং বলুন। গড়াপেটা বলুন। নির্মূল হয়ে যাবে বলে মনে হয়?
মাধবন: কখনওই না। তা হলে তো মানুষ খুন করে কেউ ফাঁসি যাওয়ার পরবর্তী কালে গোটা দেশে মার্ডার বন্ধ হয়ে যেত। ক্রাইম কখনও পুরোপুরি উচ্ছেদ হয় না। কমতে পারে। স্পট ফিক্সিং-টিক্সিংও কিছু অংশে আবার কখনও মাথা চাড়া দেবে। সেটাই স্বাভাবিক।
প্র: কিন্তু ভারত কি আইন নেই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? এমনিতেই তো ধারণা তৈরি হচ্ছে যে সাহেবরা কড়া হল। আমরা সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করলাম।
মাধবন: ওই যে বললাম আইন ছিল না। জেলের ঘানি টানানোর। অবশ্য জেল হত কি না জানি না। এটা আদালতের ব্যাপার তো। কিন্তু ট্রায়াল অবধিও নিয়ে যেতে পারিনি। ব্রিটেনেও আইনটা আগে ছিল না। তিন-চার বছর আগে ওরা পাশ করেছে।
আসলে আমাদের আইন প্রণয়নকারীরা বোধহয় এতটা গুরুত্ব দেননি। ওঁরা ভেবেছিলেন সাংঘাতিক সব অপরাধের আগে মোকাবিলা করার কথা ভাবি। এটা সমাজের আর কত অংশকে প্রভাবিত করছে। গুরুত্ব দেননি।
প্র: কিন্তু ম্যাচ ফিক্সিং কি এক অর্থে রাজদ্রোহ নয়? দেশের হয়ে তুমি কোটি কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছ। তাদের বিশ্বাস-মানমর্যাদাকে যদি ইচ্ছাকৃত ঠকাও, সেটা এক রকমের দেশদ্রোহিতা নয়?
মাধবন: আমার মনে হয় স্পোর্টস মিনিস্ট্রি এ রকম একটা বিল আনার কথা ভাবতেই পারে। এই দেশদ্রোহিতার দৃষ্টিকোণ থেকে। যাতে ভবিষ্যতে দোষীরা উচিত শাস্তি পায়। তবে হুড়মুড়িয়ে কিছু করার প্রয়োজন নেই। অন্য দেশে এই সম্পর্কিত আইনকানুন কী আছে সব খতিয়ে দেখতে হবে। তার পর তাকে ভারতের পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী কাটছাঁট করে নিতে হবে।
ইংল্যান্ডের কথা বলছেন তো। ও দেশে অনুসন্ধানের একটা সুবিধে হল, সংগঠনগুলো সেখানে ঠিকঠাক কাজ করে। গড়পড়তা মানুষের সততাও বেশি। শুধু উপমহাদেশে নয়, আমি বলব ইংল্যান্ড সমাজে সার্বিক সততা আমেরিকার চেয়েও বেশি।
প্র: আপনি আর কোনও ধারা অনুযায়ী ক্রিকেটারদের শাস্তি সুপারিশ করার কথা ভেবেছেন?
মাধবন: আইনটা সরাসরি খেলাকেন্দ্রিক হতে পারে যে, অসৎ কাজের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এমন কাউকে যে খেলার স্পিরিট না মেনে কেবল টাকা রোজগারের ফন্দি দেখিয়েছে। বঞ্চনা করেছে।
প্র: বোর্ডের তদন্তে আপনি যখন নামেন, তত দিনে সিবিআই থেকে বছর ছয়েক অবসর নিয়ে ফেলেছেন। কাজে অসুবিধে হয়নি? কেউ হুমকি দেওয়া বা কিছু চেপে যেতে বলা এমন ঘটেনি?
মাধবন: একেবারেই না। মিস্টার মুথাইয়া তখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট। উনি পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন আমায়। সত্যি বলতে কী সবাই যে সাক্ষ্য দিতে এসেছিল তাতে তদন্তের সুবিধেই হয়। একমাত্র...
প্র: একমাত্র?
মাধবন: একমাত্র আজহার কিছুতেই আসতে চাইছিল না। আমি হায়দরাবাদ অবধি দৌড়েছিলাম ওর জন্য। বারবার না করে দিচ্ছে। তার পর আমি বলতে বাধ্য হলাম, একেবারে যদি না আসেন, তা হলে সাক্ষ্যপ্রমাণের বিরুদ্ধে আপনার কোনও বক্তব্যই উপস্থিত থাকবে না। তাতে ফল আরও খারাপ হতে পারে। তখন বহু বোঝানোর পর আজহার আসে।
প্র: এই সময়ে ইন্ডিয়ার ক’টা ম্যাচ মোট গড়াপেটা হয়েছিল?
মাধবন: সেটা বলা মুশকিল। তবে হাতে যা সাক্ষ্যপ্রমাণ, বুকিদের সঙ্গে যোগাযোগের যা সব নিদর্শন ছিল, একেবারে অব্যর্থ।
প্র: শোনা যায় সচিনের সাক্ষ্য কোনও কোনও ক্রিকেটার সম্পর্কে আপনাকে আলোকিত করেছিল?
মাধবন: না, না। সচিন অন্য কারও ব্যাপারে কিছু বলেনি। ও আমদাবাদ ম্যাচে ফলো অন না করানো নিয়ে নিজের ব্যাখ্যাটা আমায় দিয়েছিল। যা আমার মনে হয়েছিল সন্তোষজনক। সচিন খুব ভদ্র। খুব অমায়িক ছেলে। ওর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আমার হোটেলে সাক্ষ্য দিতে এসেছিল। ওর স্ত্রী বললেন, ও ঘরে থাকল। আমি লবিতে অপেক্ষা করছি। আমি বললাম সে কী কথা! আপনি থাকুন। উনি ঘরের একটা কোণে বসে থাকলেন। আর একটা কোণে বসে আমি সচিনের সঙ্গে কথাবার্তা সারলাম।
প্র: নেট-এ আপনার রিপোর্ট খুললেই দেখা সম্ভব। আজ জনতার সম্পত্তি। আর সেটা দেখলে মনে হয় আপনি সবচেয়ে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন মনোজ প্রভাকর সম্পর্কে। বলেছেন, ও-ই হল পথিকৃৎ।
মাধবন: মনোজ তো আছে। কিন্তু।
প্র: কিন্তু কী?
মাধবন: কিন্তু ক্যাপ্টেন কী করে এটা করেছিল।
প্র: এগারো বছর পরেও মনে হচ্ছে আজহারের জড়িত থাকাটা আপনাকে কোথাও ধাক্কা দিয়েছিল?
মাধবন: ইয়েস আই ওয়াজ শক্ড। আমি যৌবনে ক্রিকেট খেলতাম। এত অভিজ্ঞতার পরেও বিস্ফারিত লেগেছিল, দেশের অধিনায়ক কিনা এই ঘৃণ্য কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে! |