না আছে দক্ষতা, না আছে পরিকল্পনা বিপর্যয় মোকাবিলায় দমকলের এই ‘অসহায়’ মুখটাই বারবার দেখছে শহর। দু’বছর আগে স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডের বলি হয়েছিল ৪৩টি প্রাণ। দমকলের উপযুক্ত বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থা থাকলে তা যে অনেকটা এড়ানো যেত, সেটা সকলেই পরে স্বীকার করেছেন। কিন্তু, দু’বছর পরেও পরিস্থিতি যে সেই তিমিরেই, শুক্রবার সকালে ফের তা দেখল উল্টোডাঙার পুলিশ আবাসন। এ বার অবশ্য তা ঘটল একটি কুকুরকে কেন্দ্র করে।
বৃহস্পতিবার রাতে কোনও ভাবে ওই আবাসনের সাততলায় জানলার কার্নিসে আটকে পড়েছিল সেই কুকুরটি। খবর পেয়ে এ দিন সকালে পৌঁছন দমকলকর্মীরা। গলায় দড়ি বেঁধে প্লাস্টিকের চাদরে বসিয়ে তাকে নামিয়ে আনতে গেলে ভয়ে ছটফটিয়ে কুকুরটি নীচে পড়ে যায়। শিরদাঁড়া ভেঙে যায় তার। অথচ, উপর থেকে নীচে পড়লে কুকুরটি যাতে আঘাত না পায়, তার জন্য ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে দমকলের সদর দফতর থেকে নিয়ে আসা যেত অত্যাধুনিক কুশন বা জাল। নিরাপদে তাকে নামিয়ে আনতে ২১ তলা পর্যন্ত ওঠা যায়, এমন অত্যাধুনিক সিঁড়িও ছিল দমকলের কাছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কোনওটাই নিয়ে যাওয়া হয়নি ঘটনাস্থলে। এমনকী, উপস্থিত দমকলকর্মীরা আলোচনা করেননি উচ্চপদস্থ অফিসার বা কুকুরদের উদ্ধারকারী কোনও সংস্থার সঙ্গেও।
|
নীচে পড়ার আগে।
কার্নিসে সেই কুকুর।
ছবি: অর্কপ্রভ ঘোষ |
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কুকুরটিকে উদ্ধার করতে কার্নিসের নীচে বড় কালো রঙের একটি প্লাস্টিকের চাদর চার দিক থেকে বেঁধে দেন দমকলকর্মীরা। মোটা দড়ির ফাঁস বানিয়ে উপর থেকে তা কোনও রকমে কুকুরটির গলায় আলগা করে পরিয়ে দেওয়া হয়। দমকলকর্মীদের তত্ত্বাবধানে এর পরে আবাসনের কয়েক জন যুবক লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে সেই কুকুরটিকে প্লাস্টিকের উপরে লাফাতে বাধ্য করেন। ভয়ে তখন ঠকঠক করে কাঁপছিল সে।
দমকলকর্মীদের পরিকল্পনা ছিল, প্লাস্টিকের উপরে পড়ার পরে চারপাশ থেকে প্লাস্টিকের বাঁধন খুলে উদ্ধার করা হবে কুকুরটিকে। তাঁরা ধরেই নেন, ততক্ষণ কুকুরটি শান্ত হয়ে বসে থাকবে। কিন্তু প্লাস্টিকে পড়ার পরে ভয়ে অসহায় কুকুরটি ছটফট করতে শুরু করে। পায়ের নীচে শক্ত জমির খোঁজে ছটফটানিতে গলার ফাঁস খুলতে সময় নেয় কয়েক সেকেন্ড। পাতলা প্লাস্টিকের চাদর কুকুরের ভার সামলাতে পারেনি। এক দিকের বাঁধন খুলে যেতে সাততলা থেকে সটান নীচে কংক্রিটের উপরে আছড়ে পড়ে কুকুরটি। ভয়ে কঁকিয়ে ওঠে এতক্ষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে দমকলের উদ্ধারকাজ দেখা ভিড়টা।
স্টিফেন কোর্টের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হত। হাতে তখন সময় ছিল না। কিন্তু এ দিন দমকলকর্মীদের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। তবু মই বা কুশন আনা হল না কেন? ঘটনাস্থলে উপস্থিত দমকলকর্মীরা এর সদুত্তর দিতে পারেননি। দমকলের কলকাতা বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর অসিত সরকার বলেন, “যে অফিসার উদ্ধারে গিয়েছিলেন, তিনি অভিজ্ঞ। আগে অনেক বার উদ্ধারের কাজ সফল ভাবে করেছেন। খবর নিয়ে দেখেছি, ওই আবাসনে উঁচু হাইড্রলিক মই ব্যবহার করা যেত না। কুশন বা ক্যানভাস কেন নিয়ে যাওয়া হয়নি, তা খোঁজ নিচ্ছি।”
এ দিন নীচে পড়ার পরে প্রথমে কুকুরটি ঘষটে ঘষটে একটি গাড়ির তলায় আশ্রয় নেয়। এক আবাসিক বাটিতে জল এনে দেন তাকে। কুকুরের পিছনের পা দু’টি একেবারেই কাজ করছিল না। কয়েক মুহূর্ত পরে ভিড় সরে যেতে ঘষটে ঘষটে সে আবাসনের গেটের তলা দিয়ে পিছনের পিচ রাস্তায় চলে যায়।
আবাসনের আটতলার বাসিন্দা অনসূয়া ভৌমিক বলেন, “কাল রাত দেড়টা নাগাদ আচমকা কুকুরের চিৎকার শুনি। এত উপরে কুকুর কখনই ওঠে না। অন্য কুকুরের তাড়া খেয়ে বোধহয় পালিয়ে এসেছিল। সকালে আমার বাবা দেখেন, ল্যান্ডিং-এর জানলা দিয়ে লাফ মেরে কুকুরটি ওই কার্নিসে নেমেছে। আমরা প্রথমে উদ্ধার করার চেষ্টা করি। না পেরে দমকলকে খবর দিই।” ওই আবাসন থেকে ফোন পেয়ে পৌঁছন পশু চিকিৎসক সুবীর ভট্টাচার্য। তিনি জানান, কুকুরটির শিরদাঁড়া ভেঙে গিয়েছে। অস্ত্রোপচারে তা ঠিক করা মুশকিল। ও ভাবে বাঁচিয়ে রাখাটা কুকুরটির কাছেও কষ্টদায়ক। সুবীরবাবুই যোগাযোগ করেন পথ-কুকুরদের আশ্রয়দাতা এক সংস্থার সঙ্গে। তারা এসে আহত কুকুরটিকে নিয়ে যায়। |