পনেরো বৎসর পূর্বে ভারত পাকিস্তানকে ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’ অর্থাৎ ‘বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ’-এর মর্যাদা দিয়াছিল। ইসলামাবাদ এত দিনে ভারতকে সেই স্বীকৃতি দিল। ভারতকে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ হিসাবে গণ্য করা হইবে, পাকিস্তানের কিছু গোষ্ঠী তাহাতে মর্মান্তিক চটিয়াছে। তাঁহারা আশ্বস্ত হইতে পারেন, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ প্রকৃত অর্থে কোনও বিশেষ সুবিধা পায় না। যে কোনও দুইটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য হইলেই তাহারা কার্যত পরস্পরের ‘মোস্ট ফেভারড’ হইয়া ওঠে। বস্তুত, এই স্বীকৃতির একটিই তাৎপর্য ইহা বলিয়া দেয় যে সংশ্লিষ্ট দেশটির সহিত বাণিজ্যিক বৈর নাই। প্রশ্ন উঠিতেই পারে, ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যখন বিবিধ দ্বন্দ্বে দীর্ণ, তখন দেশ দুইটির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়িয়া উঠিতে পারে কি? ভারত এবং চিনের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক সম্পর্কের নজিরে এই প্রশ্নটির উত্তর নিহিত আছে। এই দুইটি দেশের সম্পর্কেও বহুবিধ কাঁটা বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ হইতে পাক অধিকৃত কাশ্মীর, সমস্যার অভাব নাই। কিন্তু, সেই সম্পর্ক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পথে বাধা হয় নাই। ভারত এবং পাকিস্তানের সম্পর্কও সেই পথেই হাঁটিতে পারে। একবিংশ শতকে কূটনীতি অর্থনীতির পদাঙ্ক অনুসরণ করিবে বলিয়াই আশা। অতএব, এই দুইটি দেশের সম্পর্কের উন্নতির স্বার্থেও বৃহত্তর বাণিজ্যিক সংযোগ প্রয়োজন।
পাকিস্তানের মোট রফতানির সামান্য অংশই এখন ভারতে আসে। ভারতের মোট আমদানিতে পাকিস্তানের ভাগ আরও নগণ্য। কিন্তু, পাকিস্তানে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা বিপুল। সেই পণ্য দুবাইয়ের ঘুরপথে পাকিস্তানে পৌঁছায়। পাকিস্তান ভারতীয় পণ্যের জন্য দরজা খুলিয়া দেওয়ায় সেই দেশের আমদানি খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বেশ খানিক কমিবে। ঘটনাটিতে ভারতের পক্ষে শিক্ষণীয় একটি উপাদান আছে। কোনও প্রকট প্রত্যাশা না রাখিয়া একতরফা উদারনীতির পথে হাঁটিলে যে প্রতিপক্ষের হৃদয় পরিবর্তন করা সম্ভব, এই ঘটনা তাহার প্রমাণ। কাজেই, ভারতকে এই পথে আরও অনেকখানি হাঁটিতে হইবে। পাকিস্তানের সহিত ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ শ্রীলঙ্কা, নেপাল বা বাংলাদেশের সহিত বাণিজ্যের পরিমাণের তুলনায় কম। অবিলম্বে বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়াইতে হইবে। পাকিস্তানের পণ্যের জন্য বাজার উন্মুক্ত করিতে হইবে। এবং, প্রয়োজনে পাকিস্তানের কিছু দাবিদাওয়া মানিয়া লইতে হইবে। এখন আফগানিস্তানের পণ্য পাকিস্তানের উপর দিয়া ভারতে আসিতে পারে, কিন্তু পণ্যের বিপরীতমুখী যাত্রা নিষিদ্ধ। পাকিস্তান এই শর্তটি এখনও বলবৎ রাখিয়াছে। ভারত আপত্তি করে নাই। এই উদারতাই কাম্য।
ভারত যদি দক্ষিণ এশিয়ার অবিসংবাদী রাজনৈতিক শক্তি হইয়া উঠিতে চাহে, তবে এই উদারতা ভিন্ন গতি নাই। এই অঞ্চলে ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি প্রশ্নাতীত, কিন্তু অতীতের ভ্রান্ত কূটনীতি ভারতকে প্রতিবেশীদের নিকট জনপ্রিয় করে নাই। সেই ফাঁক গলিয়া চিন দক্ষিণ এশিয়ায় তাহার প্রভাব বিস্তার করিতেছে। বাংলাদেশ বা নেপাল বিষয়ে চিনের যতটুকু উৎসাহ, তাহা ভারতকে চাপে রাখিবার জন্যই। এই চাপ এড়াইতে হইলে ভারতকে এই অঞ্চলের আস্থাভাজন হইয়া উঠিতে হইবে। তাহা বাণিজ্যিক উদারতার মাধ্যমেই সম্ভব। প্রতিবেশী দেশগুলি যাহাতে ভারতের উপর নির্ভর করে, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কথাটি আরও বেশি প্রযোজ্য। এই দেশগুলির প্রতি উদার হওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য এখন ভারতের আছে। তাহার যথাযথ ব্যবহার প্রয়োজন। |