উন্নয়নের কাজে প্রশাসনকে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইহার ফলে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তুলনায় প্রশাসনিক আধিকারিক অর্থাৎ জেলাশাসক, মহকুমাশাসক ও ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসারদের (বি ডি ও) ক্ষমতা বৃদ্ধি পাইবে। সিদ্ধান্তটি ঐতিহাসিক এবং স্বাগত। প্রশাসনকে ঠুঁটো করিয়া রাখিয়া পঞ্চায়েতের হাতে উন্নয়নের যাবতীয় ক্ষমতা ন্যস্ত করার যে-বন্দোবস্ত বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গৃহীত হইয়াছিল এবং এত কাল ধরিয়া চলিয়া আসিতেছিল, অতঃপর তাহার পরিবর্তন ঘটিতে চলিয়াছে। বামপন্থীদের সাধের ‘ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ’-এর মডেল ‘পঞ্চায়েতি রাজ’ ইহার ফলে বহুলাংশে দাঁতনখহীন হইয়া পড়িবে। স্বভাবতই তাঁহারা মুখ্যমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তে কেবল অখুশি নন, রীতিমত ক্ষুব্ধ। তথাপি মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাইতে হইবে, কেননা ইহাই ঠিক সিদ্ধান্ত।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের তত্ত্বটি আপাতদৃষ্টিতে যত চিত্তাকর্ষকই হউক, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে উন্নয়নের দায়িত্ব তুলিয়া দেওয়ার বিষয়টি বিধানসভা অপেক্ষা নিম্নতর স্তরে ন্যস্ত হওয়া উচিত নয়। পূর্ববর্তী সরকার গ্রামস্তর অবধি এই বিকেন্দ্রীকরণকে সম্প্রসারিত করিয়াছিল। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনও যেহেতু রাজনৈতিক দলের সদস্য-সমর্থকদের লইয়াই অনুষ্ঠিত হয়, তাই পঞ্চায়েতগুলিও কার্যত দলীয় রাজনীতিরই আখড়া হইয়া ওঠে। কোথায় রাস্তা হইবে, কোথায় গভীর নলকূপ খোঁড়া হইবে, কোথায়ই বা প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়নের নৈর্ব্যক্তিক প্রয়োজন হইতে তাহা নির্ণীত হয় না, নির্ধারিত হয় সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের মর্জি অনুযায়ী। বস্তুত এই দলবাজি তথাকথিত স্বশাসিত পঞ্চায়েতগুলিকে এতটাই আচ্ছন্ন করিয়া রাখে যে, বন্যার্তদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত ভাগ্যবিড়ম্বনার প্রতিবিধানেও আর্তদের দলপরিচয় প্রাধান্য পাইয়া থাকে। প্রায়শ বি ডি ও, এস ডি ও এবং জেলাশাসকদের মতো আধিকারিকদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করিয়া পঞ্চায়েতগুলি রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার চালাইয়া থাকে। আবার বহু ক্ষেত্রে নির্বাচিত পঞ্চায়েত থাকিলেও তাহা অকর্মণ্য পড়িয়া থাকে, উন্নয়নের কোনও কাজই করে না, হয় নিজেদের মধ্যে বিবাদের জেরে, নতুবা জঙ্গলমহলের মতো উপদ্রুত অঞ্চলে জনপ্রতিনিধিদের অবাধ গতিবিধির সমস্যায়। এই সব ক্ষেত্রেই বি ডি ও-এস ডি ওদেরই দায়িত্ব বর্তায় পঞ্চায়েতের কাজ করার।
মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি হইল, প্রশাসনিক আধিকারিকরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তুলনায় নিরপেক্ষ, কোনও দলের কাছে তাঁহাদের মাথা বিকাইয়া নাই, তাই তাঁহাদের হস্তে উন্নয়নের দায়িত্ব সমর্পণ করাই শ্রেয়। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের উন্নয়নে যে তাঁহার দলের তুলনায় তাঁহার প্রশাসনের উপর অধিকতর আস্থা জ্ঞাপন করেন, এই সিদ্ধান্তে তাহারও পরোক্ষ প্রতিফলন রহিয়াছে। মনে রাখা দরকার, রাজ্যের নির্বাচিত পঞ্চায়েতগুলির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইতিমধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেসের কব্জায়। ভবিষ্যতে যে নির্বাচন আসন্ন, তাহাতেও বিধানসভা ভোটের জের অব্যাহত থাকিবে, এমন সম্ভাবনা স্পষ্ট। তবু যে মমতা গ্রাম বাংলার রাজনৈতিক দখল নিজের দলকে দেওয়া অপেক্ষাও উন্নয়নের কাজকর্ম প্রশাসনকে দিয়া করাইতে ইচ্ছুক, তাহাতে বুঝা যায়, জনকল্যাণে আধিপত্যকামী দলীয় রাজনীতি অপেক্ষা দায়বদ্ধ প্রশাসনকে তিনি বেশি বিশ্বাস করেন। উন্নয়নকে রাজনীতি-বিযুক্ত করিতে হইলে কর্মসূচি গ্রহণ, তাহার রূপায়ণ সরকারি তহবিলের উপযোগ সব কিছুই প্রশাসনের হাত দিয়া হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তাহাতে স্বচ্ছতা যেমন থাকে, দক্ষতাও নিশ্চিত করা যায়। |