রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু পেট্রোপণ্য নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার ব্যাপারে আর পিছনে হাঁটবে না কেন্দ্রীয় সরকার। আজ কান-এ জি-২০ সম্মেলনের ফাঁকেই এক সাংবাদিক বৈঠকে স্পষ্ট করে এই সাহসী প্রত্যয়ের কথা জানিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
গত কাল রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলি আর এক দফা পেট্রোলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই দেশের বিভিন্ন অংশে প্রতিবাদ শুরু হয়। বিরোধীরা তো মুণ্ডপাত করছেনই। আজ সরকারের প্রধান শরিক দল তৃণমূল পর্যন্ত জোট সরকার থেকে বেরিয়ে আসার ‘চরম হুঁশিয়ারি’ দিয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী কিন্তু স্পষ্ট করে দেন, যতই চাপ থাকুক, পেট্রোপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আর হাতে নেবে না সরকার। বরং পেট্রোলের পাশাপাশি ডিজেল-সহ অন্যান্য পেট্রোপণ্যও নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার পথেই হাঁটবে তারা। কারণ, গোটা বিশ্ব এখন এই অভিমুখেই এগোচ্ছে। তাঁর বক্তব্য, “বাজারই মূল্য নির্ধারণ করবে। আমাদের আরও বেশি বিনিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটা উচিত।”
কান-এ প্রধানমন্ত্রী যখন এই কথা বলছেন, তখন তাঁর পাশে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া, যিনি আর্থিক সংস্কারে মনমোহনের অন্যতম সেনাপতি বলেই পরিচিত। দিল্লিতে অর্থ মন্ত্রকের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসুর গলাতেও একই সুর শোনা গিয়েছে। শরিক তথা বিরোধী দলগুলি দাবি তুলেছে, পেট্রোলের দাম বাড়ার ফলে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে মূল্যবৃদ্ধির বোঝা আরও বাড়বে। কিন্তু কৌশিকবাবুর যুক্তি, ডিজেলের দাম নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দিলে আখেরে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আসবে। অর্থনীতির তত্ত্ব দেখিয়ে কৌশিকবাবুর ব্যাখ্যা, নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হলে ডিজেলের জন্য সরকারকে আর ভর্তুকি দিতে হবে না। ভর্তুকির বোঝা হালকা হলে কমবে আর্থিক ঘাটতি। আর্থিক ঘাটতি কমলে মূল্যবৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। অর্থ মন্ত্রকের আমলারা বলছেন, কৌশিকবাবুই প্রথম নন, প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান সি রঙ্গরাজন বা মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ারা এই যুক্তিই দিয়ে আসছেন। আবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “পেট্রোলের মূল্য নির্ধারণের ওপর সরকারের আর এক্তিয়ার নেই। তা রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলির হাতে।”
কান-এ একই যুক্তি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সূত্রও। সেই সূত্রটির মতে, মমতা প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন। কিন্তু এই নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে কী হবে? বিষয়টি তো আর সরকারের হাতে নেই। চলে গিয়েছে তেল সংস্থাগুলির হাতে। |
এ সব বলা সত্ত্বেও এবং পেট্রোপণ্য নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার পথে হাঁটার কথা বলেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু দেশের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কথা ভোলেননি। তাই তিনি বলেছেন, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কাজটা করতে তো হবেই। কিন্তু দেশে যে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেটাও ঠিক। তাই সাবধানে কাজটা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দেশের যা পরিস্থিতি তাতে খরচ কমাতে হবে। সে জন্য সরকারের খরচ কমাতে হবে। কমাতে হবে ভর্তুকিও। আবার অন্য দিকে বিলগ্নিকরণও প্রয়োজন। এই পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বই এখন জ্বালানি তেলের বিনিয়ন্ত্রণ করছে। ভারত সেই পথেই এগোবে।
কিন্তু অর্থনীতির এই ভাষা কি রাজনীতি বুঝতে পারছে?
আজ দিল্লিতে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া দেখার পর সেই প্রশ্নও উঠে গিয়েছে। গোটা দেশে শরিক-বিরোধী সব স্তরে প্রতিবাদ দেখার পরে কংগ্রেসকেও বলতে হচ্ছে, মানুষকে সুরাহা দিতে সরকার অবিলম্বে কিছু একটা ব্যবস্থা নিক। অথচ দেড় বছর আগে এই কংগ্রেসই পেট্রোলের বিনিয়ন্ত্রণে সায় দিয়েছিল। কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র তথা ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য জনার্দন দ্বিবেদীর বক্তব্য, “বিনিয়ন্ত্রণের যুক্তি অনেকেই বোঝেন না। শুধু এটা বোঝেন, তেল বিপণন সংস্থাগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত, তাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তাই সরকার চাইলেই মানুষকে সুরাহা দিতে পারে। সরকারের কাছে কংগ্রেসের দাবি, মানুষকে সুরাহা দিতে একটা পথ বের করা হোক।”
যদিও পরে কংগ্রেস শীর্ষ সূত্রে বলা হয়েছে, তৃণমূল, ডিএমকে, এনসিপি-র মতো শরিকরা যে ভাবে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে, তাতে সরকারের পাশে দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতি আজ ছিল না। তা ছাড়া কংগ্রেসের ঘরোয়া চাপও রয়েছে। সামনেই পঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড ও উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। দেশ জুড়ে লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি সেখানে কংগ্রেসের সম্ভাবনায় জল ঢালতে পারে বলে এর মধ্যেই দলের অন্দরে প্রবল আশঙ্কা। প্রধানমন্ত্রীও আজ স্বীকার করেছেন, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বেড়েই চলেছে। তাঁর বক্তব্য, যদিও এটা দেশের বাড়তি চাহিদারই ইঙ্গিত, তবু দেখতে হবে, কোনও ভাবেই বিষয়টি যেন হাতের বাইরে চলে না যায়। স্বাভাবিক ভাবে এই পরিস্থিতিতে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করা ছাড়া কংগ্রেসের উপায় ছিল না।
কংগ্রেসের এক শীর্ষ সারির নেতা বলেছেন, এ দেশে অর্থনীতির যুক্তিকে বরাবরই রাজনীতি গ্রাস করেছে। অথচ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সকলেই এটা বোঝেন যে, পেট্রোলের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের অর্থ হল সরকারের ভর্তুকির বোঝা বাড়ানো। আর ভর্তুকির বোঝা বাড়লে একশো দিনের কাজ বা খাদ্য সুরক্ষার মতো সামাজিক প্রকল্প রূপায়ণের অর্থ জোগানো মুশকিল হবে (এই কথাটা আজ কান-এ প্রধানমন্ত্রীও বুঝিয়ে দিয়েছেন)। তা সত্ত্বেও যখন বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের দাবি উঠেছে, তখন শরিক দলের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। যে হেতু কেন্দ্রে জোট সরকার চলছে, তাই কংগ্রেসের কথাই শেষ কথা হওয়া সম্ভব নয়। শরিকদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
তবে অনেকেই মনে করছেন, কংগ্রেস আজ যে ভাবে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে সেটা একেবারেই কৌশলগত। তারা দেখাতে চাইছে, শাসক দলই যখন দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করছে, তখন বিরোধী দলের আপত্তির কোনও গুরুত্ব নেই। একই ভাবে মমতার হুঁশিয়ারির মোকাবিলাও করতে চেয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি বলেন, “মমতার অসন্তোষ সঙ্গত। তা ছাড়া কংগ্রেস নিজেই তো মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আপত্তি করছে।”
দল যে কৌশলই নিক, মনমোহন কিন্তু নিজের জায়গায় অটল। আর এটা নতুন কোনও ঘটনা নয়। ইউপিএ-র প্রথম জমানায় আমেরিকার সঙ্গে তিনি যখন পরমাণু চুক্তি করছেন, তখন প্রবল বাধা এসেছিল বামেদের তরফ থেকে। ২০০৮ সালের জুলাইয়ে তারা সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলেও নেয়। তা সত্ত্বেও নিজের জায়গায় অটল থেকে তিনি আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি করেন। এ ক্ষেত্রেও আর এক বার তাঁর সেই দৃঢ়তা দেখা যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। বিশেষ করে আজ তিনি যে ভাবে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন, তাও কিছুটা অভাবিত। সাধারণত দেশে ফেরার পথে বিমানে এই ধরনের সাংবাদিক সম্মেলন হয়। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু কান-এই মুখোমুখি হলেন সাংবাদিকদের। দেশীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা না করাটাই সেখানে দস্তুর। অথচ একে একে যুক্তি দিয়ে তিনি বললেন, কেন পেট্রোপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা প্রয়োজন। এর থেকেই বোঝা যায়, দেশে পৌঁছনোর আগেই নিজের মত সব মহলের কাছে পৌঁছে দিতে চান তিনি।
স্বাভাবিক ভাবেই সরকার-বিরোধী এই পরিস্থিতি কাজে লাগাতে বিজেপি ময়দানে নেমে পড়েছে। বিজেপি নেতা যশবন্ত সিনহা আজ বলেন, “গত কাল পেট্রোলের দাম বাড়ানো ছিল মধ্যরাতের মারণযজ্ঞের মতো। এমন সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহে নামা উচিত।”
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা থেকেই গেল, সংস্কার বনাম রাজনীতির এই দ্বন্দ্বের বর্তমান অঙ্কের পরিণতি কী? প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে শরিক দলগুলির সঙ্গে আলোচনার পরই তা স্পষ্ট হবে।
|
সহ-প্রতিবেদন: নয়াদিল্লি থেকে শঙ্খদীপ দাস |