প্রবন্ধ ২...
দলের মধ্যে নানা মত
খারাপ, আবার ভালও
ভারতের সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরে কোনও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে কি? সাদা চোখে তাকালে বিশেষ তফাত কিছুই চোখে পড়ে না। কেবল দ্বিতীয় ইউপিএ তার ইনিংসের মাঝপথে বেদম বিপদে। কিন্তু একটু বক্র-দৃষ্টিতে কতগুলি সম্ভাবনা গোচরে আসে। এক, ক্রমাগত দুর্নীতির অভিযোগে ন্যুব্জ ইউপিএ-র বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে। দুই, প্রধান বিরোধী দল বিজেপি আপাত উদ্দীপিত হলেও নীতিহীনতা ও নেতৃত্বের সংকটে আকীর্ণ। কংগ্রেস ও বিজেপি এই দুই প্রধান জাতীয় দলের অভ্যন্তরে যে নেতৃত্বের সংকট, তা অবশ্যই ২০১৪-র সংসদীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে এ দেশের রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে তুলবে। আমাদের সমস্যা অন্যত্র।
সাংবিধানিক ভাবে এ দেশ সংসদীয় ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সেই হিসেবে প্রতিটি দল নির্বাচনের পর নেতা নির্বাচিত করবে তাদের সংসদীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। নির্বাচনের আগে কাউকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সামনে রাখা সম্ভব নয়। সংসদীয় ব্যবস্থায় ক্যাবিনেট তথা মন্ত্রিসভা যৌথ ভাবে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ, ব্যক্তি নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ক্যাবিনেটের প্রধান, সমগ্র মন্ত্রিসভাই তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত। সুতরাং, মন্ত্রিসভায় একটি অঙ্গের ত্রুটির দায়ভার নিতে তিনি বাধ্য। টু জি স্পেকট্রাম কাণ্ডে যে ভাবে সমগ্র বিষয়টি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের নানাবিধ প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে, তাতে মনে হয়, কেন্দ্রীয় শাসক দলের অভ্যন্তরে সংহতির অভাব আছে। স্পেকট্রাম বণ্টনের ক্ষেত্রে ‘নিলাম’-এর পরিবর্তে ‘আগে এলে আগে সুযোগ’ নীতির ছাড়পত্র কি একান্তই ডিএমকে-র মস্তিষ্কপ্রসূত, না কি তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ কেউ জড়িত ছিলেন, সেই বিতর্ক চলছে। বর্তমান অর্থমন্ত্রকের বিতর্কিত নোট নিয়ে মনকষাকষিও চলছে। আমরা এও শুনছি যে, সিএজি-র অভিযোগের সম্ভাব্যতাকে কার্যত উড়িয়ে কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলে ফেলেছেন যে, আদপেই নাকি কোনও রাজস্বহানি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট কোনও অবস্থান নেই। তিনি খুব সৎ এবং সেটাই নাকি তাঁর নীতি।
নিরঙ্কুশ সংসদীয় ব্যবস্থার ভিত্তিতে বিচার করলে বলতে হয় যে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী একটি ঐক্যবদ্ধ শিবিরের মতো ন্যায় ক্রিয়াশীল নয়। আমরা এই শোচনীয়তাকে বিদ্ধ করতেই পারি। কিন্তু এর মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্ভাবনাও গড়ে উঠছে। একই শাসক গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে যদি বিভিন্ন মত সৃষ্ট হয়, তবে তা যতই দলবদ্ধ মতাদর্শগততার প্রতি হানিকর এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনে হোক, বস্তুত তা আপাত ভাবে বহুমাত্রিক এবং নির্দিষ্ট ভাবে গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের পক্ষে শুভ।
দুই কাণ্ডারী। লালকৃষ্ণ আডবাণী ও মনমোহন সিংহ
বিজেপি-র দিকে তাকালে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। লালকৃষ্ণ আডবাণী ষষ্ঠ বারের জন্য রথ-যাত্রায় বেরিয়েছেন। ১৯৯০-এর মতো তাঁকে গ্রেফতারের সম্ভাবনা নেই। তিনি যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অগ্রসরমান! অর্থাৎ, এ যাত্রায় আপাতত হিন্দুত্বের তাস তিনি খেলছেন না। ‘জনচেতনা যাত্রা’য় তিনি অণ্ণা হজারের পালের হাওয়া কাড়তে চাইছেন, না পুনরায় নিজেকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে তুলতে চাইছেন, তা স্পষ্ট নয়। হয়তো দু’টি উদ্দেশ্যই আছে। প্রথমটিতে দলের এবং দ্বিতীয়টিতে নিজের লাভ।
মুশকিল এই যে, চুরাশি বছরের বৃদ্ধকে দলের জন্য এত পরিশ্রম করতে হবে কেন? এর পেছনে নরেন্দ্র মোদীর অনশন এবং অনশনকালীন ভাষণের প্রভাব অনেকেই লক্ষ করছেন। সুষমা স্বরাজ বা অরুণ জেটলির মতো সংসদীয় মুখ জনমানসে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। সংঘপরিবার হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডায় দুর্নীতিকে জুড়ে বৃহত্তর কংগ্রেস-বিরোধী ঐক্য গড়তে উৎসাহী। অর্থাৎ, কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অগোছালো অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে উৎসাহী তাঁরা। কিন্তু শুধুই কংগ্রেসের? নিজেদের নয়?
আমরা বুঝতে পারছি বিজেপি-র সংসদীয় দলে নেতৃত্ব ধরে রাখার একটা লড়াই চলছে। ২০০৯-এ বিরোধী আসনে আডবাণী লোকসভায় দলের নেতা, আবার সুষমা স্বরাজ বিরোধী দলনেত্রী। কেমন একটা কাঁঠালের আমসত্ত্ব! ২০১৪-এ উভয়েই যদি নির্বাচিত হন এবং এনডিএ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়, তখন কী হবে?
এখানেই একটা ভাবনা জাগে। ভাবনাটা এই যে, নির্বাচনের পরে নেতা বাছাইয়ের যে সংসদীয় পথ, তা থেকে বাস্তব পরিস্থিতি কি আমাদের অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছে? প্রধানমন্ত্রিত্ব কি মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ধাঁচকে গ্রহণ করছে? হলে কিন্তু মন্দ হয় না।

মার্কিন মুলুকে ডেমোক্র্যাটিক বা রিপাবলিকান উভয় দলের যে-কেউই রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হতে পারেন। দলের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। দলের সদস্যরাই ঠিক করে দেন প্রার্থী কে হবেন। একই দলের একাধিক নেতা-নেত্রী বিতর্ক ও পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ করেন প্রকাশ্যে। দলীয় সদস্যদের নিয়ে গঠিত রাজ্য-ভিত্তিক প্রাইমারিগুলিতে নির্বাচন হয়। বিতর্ক, নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং তার ফল আবিশ্ব প্রচারিত। ইন্টারনেটে আপনি ঘরে বসে যে-কোনও প্রার্থীর প্রচারে অংশ নিতে পারেন। ভোট দিতে পারবেন না। ভোট দেন দলীয় সদস্য মার্কিন নাগরিকরা। যিনি প্রাথমিক ভোটাভুটির পরে সর্বাধিক সদস্য সংগ্রহ করতে পারেন, তিনিই হন দলীয় প্রার্থী। দলীয় শৃঙ্খলা এতে বিপর্যস্ত হয় কি?
২০০৮-এর মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে ইন্টারনেট-বাহিত হয়ে হিলারি ক্লিনটনের সমর্থনে প্রচার করেছিলাম। হিলারি মনোনয়ন পাননি, পেয়েছিলেন ওবামা। ডেমোক্র্যাটিক দলের শৃঙ্খলা তাতে ভেস্তে যায়নি। আমার মেল-বাক্সে ২৭ অগস্ট, ২০০৮-এ পৌঁছয় হিলারির এই বার্তা ‘Standing on that stage tonight in front of 20,000 Democrats unified behind Senator Obama, I saw a bright future for America...I saw a new President and a new Congress giving a voice to the voiceless. I saw America, the land of Endless potential, regaining it’s role as a leader in the world.’
দলীয় শৃঙ্খলার নামাবলি চাপিয়ে অন্তর্দলীয় বিতর্কের সুযোগকে বিনষ্ট করা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একটি দলের মতাদর্শগত অবস্থান অক্ষুণ্ণ রেখেই কোনও সমস্যার দৃষ্টিকোণগত পার্থক্যের বিচারে প্রকাশ্য বিতর্ক হতেই পারে। নির্বাচনের প্রাক্কালে না-হয় দলীয় সদস্যরাই ঠিক করে দেবেন সংসদে নেতা হবার যোগ্যতা কার আছে। সংসদীয় দল তাতে সিলমোহর বসাবে।

লেখক বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.