গ্রিসের সংকট মোচনের লগ্ন কি তবে সমাগত? শেয়ার বাজারের সূচক বলিতেছে, বাজার আশাবাদী। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে মুহূর্তে ঘোষণা করিল, গ্রিস বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি হইতে যে পরিমাণ অর্থ ধার করিয়াছে, তাহার অর্ধেক মকুব করিয়া দেওয়া হইল দুনিয়াব্যাপী বাজার ঊর্ধ্বগামী হইয়াছে। অর্থনীতির পরিভাষায় এই ঋণ লাঘবের প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ‘হেয়ার কাট’ চুল ছাঁটাইয়া লওয়া। ঋণের জটাজালের ভার খানিক কমিবে, এমন আশ্বাস পাইয়াই সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপান্দ্রিউ-এর মুখে হাসি ফুটিয়াছে। তিনি বলিয়াছেন, এত দিনে গ্রিসের ঋণ এমন একটি জায়গায় আসিল, যাহাতে সামাল দেওয়া সম্ভব। কত দিনে গ্রিস বাজারের ধার মিটাইয়া কিছু উদ্বৃত্ত রাখিতে পারিবে, তেমন একটি হিসাবও পেশ করা হইয়াছে। কঠোর অর্থনীতির পথে হাঁটিতে হইলে যে রাজনৈতিক ‘ম্যানেজমেন্ট’ প্রয়োজন, গ্রিসে তাহা নিশ্চিত করাই এখন পাপান্দ্রিউ-এর প্রধান কর্তব্য।
কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী যতখানি আশাবাদী, গ্রিসের বাস্তব ততখানি উজ্জ্বল না-ও হইতে পারে। তাহার প্রথম কারণ, বর্তমান ‘হেয়ার কাট’ শুধু বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। গ্রিসের ঋণের একটি বড় অংশের উত্তমর্ণ কোনও বেসরকারি ব্যাঙ্ক নহে, বিভিন্ন দেশের সরকার এবং সরকারি সংস্থা। সেই ঋণের বোঝা অপরিবর্তিতই থাকিতেছে। দ্বিতীয়ত, ‘হেয়ার কাট’টি ঐচ্ছিক। কোনও ব্যাঙ্ক ঋণের বোঝা কমাইতে রাজি না হইয়া বিমা সংস্থার ক্ষতিপূরণের অপেক্ষায় থাকিতে পারে। এই বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির গ্রিসের বিপদের অংশীদার হইয়া খানিক বোঝা বহন করা উচিত পাপান্দ্রিউ যতই এমন দাবি করুন, তিনি রত্নাকরের গল্পটি শুনিয়া লইতে পারেন সেই দস্যুর স্বজনরা তাহার লুণ্ঠনফল ভোগ করিয়াছিল, তাহার পাপের ভাগ স্বীকার করে নাই! বাজারের একটি হিসাব বলিতেছে, বর্তমান ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে গ্রিসের বোঝা বড় জোর ২০ শতাংশ কমিবে। মন্দ নহে, কিন্তু যথেষ্টও নহে। আর, গ্রিসের অর্থনীতি যেমন বেহাল, তাহাতে বর্তমান ত্রাণটি এক সংকট হইতে অন্য সংকটে পৌঁছাইবার সেতুমাত্র হইতে পারে। অতএব সচেতনতা জরুরি। প্রসঙ্গত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিতে নূতন মূলধনের জোগান দিতে পারে, যাহাতে ব্যাঙ্কগুলির আর্থিক স্বাস্থ্য ভাঙিয়া না পড়ে। সেই অর্থ ইউরোপিয়ান ফিনানশিয়াল স্টেবিলিটি ফেসিলিটি দিবে, না বিভিন্ন দেশের সরকার, সেই প্রশ্নটি এখনও অমীমাংসিত, কিন্তু দশ হাজার কোটি ইউরো ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে পৌঁছাইবে, তাহা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু, নূতন মূলধন আসিবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কগুলির ঋণ ও নিজস্ব সম্পদের অনুপাতটিকেও কমাইতে হইবে। তাহার অর্থ, বাজারে ঋণের জোগান কমিবে। ফল, বৃদ্ধির হার খানিক ব্যাহত হইবে। জর্জ পাপান্দ্রিউ এই হিসাবটি কষিয়াছেন কি?
গ্রিসের সমস্যা সমাধানের দীর্ঘমেয়াদি পথটি ভিন্ন সেই দেশে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ লইয়া আসিতে হইবে। ই এফ এস এফ ইতিমধ্যেই চিন, সৌদি আরব ও নরওয়ের ন্যায় দেশের কাছে বিনিয়োগের অনুরোধ জানাইয়াছে। চিন হইতে বিনিয়োগ আনিতে বিশেষ উদ্যোগী হইয়াছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক-রাজনীতিতে ইহা একটি নূতন অধ্যায়ের সূচনালগ্ন হইতে পারে। ইউরোপে জার্মানি অর্থনৈতিক মহাশক্তি, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখনও মহাদেশে বিস্মৃত হয় নাই। ফলে, রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসিতে জার্মানির সংকোচ আছে। ফলে, জার্মানি ঋণগ্রস্ত ফ্রান্সের হাত ছাড়িতে নারাজ। কিন্তু, জার্মানির হাত ধরিয়া থাকিলে ফ্রান্সের পক্ষেও ইউরোপের একচ্ছত্র নেতা হইয়া উঠা সম্ভব নহে। তাহা তখনই সম্ভব, যখন ইউরোপের বাহিরের কোনও অর্থনৈতিক শক্তি ফ্রান্সের হাত ধরিবে। চিন ছাড়া তেমন শক্তি আর কোথায়? গ্রিসের সংকট ইউরোপের রাজনীতিকে কোন নূতন খাতে বাহিত করে, তাহা দেখিবার। |