অষ্টাদশ শতাব্দীর আরবি ফারসি প্রভাবিত বাংলা পুথি সাহিত্যের আদি কবি হলেন শাহ সৈয়দ গরিবুল্লাহ। আনুমানিক ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর থানার হাফেজপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবার নাম শাহ সৈয়দ আজমতুল্লাহ ওরফে ফুলওয়ারি শাহ। তাঁর চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে প্রথম পুত্র হলেন শাহ সৈয়দ গরিবুল্লাহ ওরফে পির দেওয়ানজি। বাবার কাছে তাঁর বাল্যশিক্ষা শুরু। কয়েক বছর পঠন-পাঠনের পর তাঁর বাবা তাঁকে বলেন, ‘কেবল মুখে মুখে ধর্মালোচনা করলে হবে না, জনমানসে প্রভাব বিস্তার করতে হবে, সর্বাগ্রে মানুষকে শিক্ষিত করতে হবে। কালক্রমে পুথিপাঠের মধ্য দিয়ে তারা ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে উঠবে। এই পুথি রচনার দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে।’ পুথি রচনার প্রেরণা পেয়ে তিনি এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। এ পর্যন্ত তাঁর রচিত পাঁচটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সেগুলির নাম ‘ইউসুফ জোলায়খা’, ‘সোনাভান’, ‘জঙ্গনামা’, ‘সত্যপিরের পুথি’ ও ‘আমির হামজা’। তাঁর নিজের হাতের লেখা ‘আমির হামজা’র পাণ্ডুলিপি আজও তাঁর বংশধরদের কাছে আছে। তিনি ছিলেন সুপুরুষ ও বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী। পোশাকটি আরবীয় ধাঁচের হলেও স্থানীয় মানুষের মতো তিনি খড়ম ব্যবহার করতেন। সুফি-সাধকের মতো তিনি ছিলেন নির্জনতাপ্রিয় মানুষ। জন্মস্থান হাফেজপুর গ্রামে হলেও কৌশিকী বা কানা-দামোদরের পশ্চিম তীরে নাইকুলি গ্রামটিকে তিনি তাঁর খানকা বা সাধনাস্থল হিসেবে বেছে নেন। |
এই খানকা-য় বসে তাঁর হিন্দু-মুসলমান শিষ্যদের নিয়ে ধর্মালোচনা, সাহিত্য আলোচনা ও কাব্যপাঠে মনোনিবেশ করতেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যুর পর এখানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। বর্তমান সমাধিসৌধটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বর্ধমান মহারাজার দেওয়ান নির্মাণ করিয়ে দেন। সাহিত্যের ইতিহাস, সরকারি নথিপত্র এবং বংশধরদের দেওয়া তথ্যাদির ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে, শাহ সৈয়দ গরিবুল্লাহ ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বর্তমান ছিলেন। তাঁর জন্মদিন ২৩ ভাদ্র এবং মৃত্যুদিন ১১ কার্তিক। তাঁর মৃত্যুদিন বা এন্তেকাল দিবসকে স্মরণ করা হয়। সমাধিসৌধ বা মাজার প্রাঙ্গণে হয় ইসালে সওয়ার। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ সমবেত ভাবে পির ও কবির সমাধিসৌধে ফুল ধূপ ও বাতি দিয়ে জিয়ারত বা প্রার্থনা করেন। সারা রাত ধরে তাঁর জীবনী ও ধর্মালোচনা হয়। এই স্থানটি হিন্দু-মুসলমান সমেত সব ধর্মের মানুষের কাছে সংহতি ও সম্প্রীতির মিলনভূমি। এই সমাধিস্থলকে পির দেওয়ানজির মাজার শরিফ বলা হয়। বর্তমানে গড়ে উঠেছে শাহ গরিবুল্লাহ মাজার ও সম্পত্তি উন্নয়ন সংস্থা। এটি রাজ্য সরকারের পুরাকীর্তির তালিকায় স্থান পেয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ পর্যন্ত এর জন্য সরকারি ভাবে কোনও উদ্যোগ নেই। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন আসেন। এখানে অনায়াসেই গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র। পির ও কবির স্মৃতিরক্ষার্থে গড়ে উঠতে পারে সরকারি গার্লস মাদ্রাসা। সে জন্য উপযুক্ত জায়গাও আছে। যাত্রীনিবাস, পরিবেশ সৌন্দর্যায়ন, রাস্তা সংস্কার, পানীয় জলের ব্যবস্থা করার আবেদন জানাচ্ছেন সৈয়দ আবদুল সুলতান, কাশীনাথ আদক-সহ এলাকার সকল মানুষ। বেশ কয়েক বছর আগে কবি শাহ গরিবুল্লাহর স্মরণে সাহিত্য-সংস্কৃতি মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমান সরকারের কাছে আবেদন, এই পুরাকীর্তি জাতীয় সম্পদ। আসুন, পির ও কবি শাহ গরিবুল্লাহর প্রতি আমরা উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করি।
গোপীকান্ত মেথুর। কৃষ্ণনন্দপুর, মুন্সির হাট, হাওড়া
|
এই বিভাগে চিঠি পাঠান সম্পূর্ণ নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করে।
আমাদের চিঠি,
সম্পাদকীয় বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা প্রাঃ লিঃ,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১ |
|