|
|
|
|
|
|
|
একা নয়, কয়েক জন
মিলে করি কাজ |
|
অনেককে নিয়েই তৈরি হয় একটা টিম। কিন্তু তার সাফল্য নির্ভর করে সেই ব্যক্তিরা কী ভাবে,
কোন মানসিকতা নিয়ে চলে, তার ওপর। সেখানেই লুকিয়ে আছে সফল টিমওয়ার্ক-এর রহস্য।
লিখছেন প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্স সংস্থার ‘লার্নিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’
বিভাগে
ডিরেক্টর
বীর্যেন্দু গুপ্ত। |
টিমওয়ার্ক শব্দটার দুটো ভাগ: টিম আর ওয়ার্ক। দুটো মিলিয়ে যে শব্দটি তৈরি হল, তার ক্ষমতা অপরিসীম। টিমওয়ার্ক দিয়েই এমন অনেক কাজ করা গিয়েছে, যা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব। অনেকে একসঙ্গে কাজ করেছে বলেই মানুষ চাঁদে গিয়েছে, কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়েছে, সমুদ্রের নীচে সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে। আবার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কত কিছুই না আমরা টিমওয়ার্ক দিয়ে করি স্কুল ম্যাগাজিন তৈরি করি, একে অন্যের থেকে বহু দূরে বসে দল বেঁধে কম্পিউটার সফটওয়ার তৈরি করি, উড়োজাহাজ বানাই। অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়র বিষয়ক যে কোনও ম্যানেজমেন্ট-এর বইয়ে টিমওয়ার্ক নিয়ে আলোচনা থাকে একটা টিম কী ভাবে কাজ করে, তার সদস্যদের পারস্পরিক টানাপড়েন কী ভাবে চলে, কীসের গুণে একটা টিম তৈরি হয়, কেনই বা ভেঙে যায়, টিম তৈরি হওয়ার ধাপগুলো কী, ইত্যাদি।
এই তো আমরা দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, সব সেরে উঠলাম। বাঙালির এই সবচেয়ে বড় উৎসবের মরসুমে টিমওয়ার্ক খুব দরকারি। কেন? আচ্ছা, ধরো, পাড়ার বন্ধুরা মিলে ভাবছ একটা পুজো করবে। এই প্রথম। তা, ব্যাপারটা শুরু হবে কী ভাবে? হয়তো এক জন বা কয়েক জন বলল, ‘চলো, সামনের বছর পুজো করি।’ কয়েক জন তাতে সায় দিল, কয়েক জন বলল, ‘না না, দরকার নেই।’ তা হলে? সহজ সমাধান কে কে পুজো করতে চাও, হাত তোলো। হুজুগে বাঙালি একুশ শতকেও স্বধর্মভ্রষ্ট হয়নি, অতএব বেশির ভাগই চটপট উঠে পড়ল। পুজো হবে। সিদ্ধান্ত স্থির করার জন্য ভোট নেওয়াই সবচেয়ে প্রচলিত উপায়।
এ বার সিদ্ধান্ত রূপায়ণের পালা। প্রথমেই কিছু কর্মী দরকার, ভলান্টিয়ার, যারা নানা ধরনের কাজ করতে পারে। আনুষ্ঠানিক ভাবে নেতা নির্বাচন না করলেও এক জন না এক জন গোটা টিমটাকে চালানোর দায়িত্ব নিয়ে নেবেই। সে-ই জানতে চাইবে, ‘কে কে কোর গ্রুপে থাকতে চাও?’ একটা দুটো করে হাত উঠবে, দেখতে দেখতে কোর গ্রুপ তৈরি হয়ে যাবে, যারা ‘আমাদের পাড়ার পুজোকে দারুণ ভাবে সফল করে তুলতে’ উদয়াস্ত খাটবে। কোর গ্রুপটির একটি লক্ষ্য হতে পারে: প্রথম বছরেই আমরা একটা পুরস্কার জিতে নেব।
দেখ, কয়েক জন ব্যক্তি একটা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এ ক্ষেত্রে, সর্বজনীন পুজো আয়োজনের জন্য একত্র হয়েছে। এটাই হল টিম গঠনের পর্ব। সম্ভবত, প্রথম দিকে টিমের কিছু কিছু সদস্যের মনে একটা দ্বিধার ভাব থাকে, কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকে, কে কোন কাজ করবে, কে নেতৃত্ব দেবে, এই সব নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকে অনেকের মনে। |
|
আস্তে আস্তে টিমের সদস্যরা পরস্পরকে চিনতে পারে, বুঝতে পারে। এই চেনাজানার পথে মতের অমিল হয়, মনোমালিন্য হয়, বিশেষ করে নিন্দুকরা তো বলেই যে বাঙালি ঝগড়া না করে বাঁচতে পারে না! বিশেষজ্ঞরা এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে থাকেন। বিরোধ বা দ্বন্দ্ব দু’রকমের হতে পারে ‘সৃষ্টিশীল দ্বন্দ্ব’ এবং ‘ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব’। প্রথম গোত্রের দ্বন্দ্ব-সংঘাত একটা কার্যকর, সফল টিম গড়ে তুলতে সাহায্য করে, দ্বিতীয়টা তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। (এ বিষয়ে ফ্রেড লুথানস-এর ‘অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়র’ বইটির ৪৪১ পৃষ্ঠা দেখতে পারো।) সৃষ্টিশীল দ্বন্দ্ব মানে হল, যখন একটা টিমের সদস্যরা কোনও একটি বিষয়ে প্রবল তর্কের তুফান তুলবে, কিন্তু তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া দারুণ জোরদার থাকবে। টিম তৈরি হওয়ার এই পর্বটাকে ‘স্টর্মিং’ বলা হয়। বাংলায় বলতে পারো, তুফান পর্ব। এই পর্বে টিমটাকে সংহত রাখা খুব জরুরি। সে জন্য দলের কয়েক জনকে ঠান্ডা মাথায় প্রয়োজনে অন্যদের সামলনোর দায়িত্ব পালন করতে হয়।
একটা টিমে বিভিন্ন সদস্য বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে। কার কী কাজ বা দায়িত্ব, সেটা প্রত্যেকের সামর্থ্য, দক্ষতা, প্রবণতা, মানসিকতা ইত্যাদি গুণাবলি অনুসারে ঠিক করা উচিত। যে ভাল শিল্পী বা যার শিল্পবোধ ভাল, তাকে মণ্ডপসজ্জার দায়িত্ব দিতে হবে, এটা সাধারণ বুদ্ধির কথা। অন্য কয়েক জন তাকে সাহায্য করবে। যার জনসংযোগ ভাল, তাকে স্যুভেনিরের জন্য বিজ্ঞাপন জোগাড় করার দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এই ভাবে ঠিক ঠিক কাজ ভাগ করে দিলে দ্বন্দ্ব-বিরোধও ক্রমশ কমে আসবে, গোটা টিমটা একযোগে ‘আমাদের পুরস্কার পেতেই হবে’ ভেবে কাজ করবে। এই পর্বটাকে বলে ‘নর্মিং’ বা ‘নির্মাণ পর্ব’।
কেন হয় এটা? কীসের তাগিদে একটা টিমের অনেক সদস্য ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র ও পারস্পরিক মতানৈক্য সরিয়ে রেখে এক হয়ে কাজ করতে চায়? অবশ্যই, সাফল্যের। আমরা যে লক্ষ্য সামনে রেখেছি, আমাদের সেখানে পৌঁছতে হবে এটাই একটা দলকে চালিয়ে নিয়ে যায়, কারণ সাফল্যটা গোটা দলকে, দল হিসেবে, অর্জন করতে হবে, আলাদা ভাবে সেটা হওয়ার নয়। শেষ পর্যন্ত যদি সত্যিই ‘আমাদের পুজো’র হাতে পুরস্কারটা আসে, গোটা দলের কত আনন্দ, কত গর্ব, ভাবো তো!
পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেক দিন টিমের সদস্যদের মধ্যে আলোচনা চলে, কোনটা ঠিক ঠিক হয়েছে, কোথায় ভুল হয়েছে, কোনটা আরও ভাল হতে পারত, ইত্যাদি। কল্ব নামে এক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন ‘ডাবল লুপ লার্নিং’-এর কথা। এর মানে হল, আমরা এক দিকে যা করেছি সেটা পর্যালোচনা করি, তার থেকে শিক্ষা নিই এবং অন্য দিকে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা ঠিক করি। যে টিম এই দুটো কাজ ভাল ভাবে করতে পারে, তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। যারা এটা পারে না, তারা সাধারণত একে অন্যকে দোষারোপের কু-অভ্যাসে মগ্ন হয়। দোষারোপ করতে গিয়ে তারা সমস্যাগুলোকে ঠিক ভাবে চিনতেই শেখে না। যে টিম সমস্যাগুলোকে ঠিক ভাবে চিনতে শেখে, তারা বছরের পর বছর আরও ভাল, আরও ভাল পুজো করতে পারে, পুরস্কার পেতেই থাকে।
নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ যে, আমি পুজো ব্যাপারটাকে একটা প্রতীক হিসেবে নিয়েছি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা এমন অনেক কিছু করি, যার প্রত্যেকটিই এক একটি ‘পুজো’, কোনওটা ছোট, কোনওটা বড়। এই সব ‘পুজো’য় আমরা, এক একটি টিমের সদস্যরা প্রত্যেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। বস্তুত, টিমে প্রত্যেকের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। এই কথাটা যদি সবাই বুঝি এবং মানি, কার ভূমিকা ছোট, কার বড়, সেটা বিচার করতে না বসি, তা হলেই টিম সফল হবে। রেষারেষির মনোভাব থাকলেই বিপদ। শেষ কথা একটাই। একটা টিম তখনই সফল হয়, যখন তার প্রত্যেক সদস্য গোটা টিমের লক্ষ্যটাকে নিজের একমাত্র লক্ষ্য বলে মনে করে, আলাদা কোনও ব্যক্তিগত লক্ষ্যকে মনে স্থান দেয় না।
|
|
|
|
|
|