শতকরা ৬ না শতকরা ২৬? না কি, শতকরা ৩৭? পশ্চিমবঙ্গের বাতাসে কিছু সংখ্যা ভাসিতেছে। বিতর্কিত সংখ্যা। বিতর্কের দুই প্রান্তে দুই অর্থমন্ত্রী। এক জন বর্তমান, এক জন ভূতপূর্ব। বর্তমান অমিত মিত্রের হিসাব বলিতেছে, রাজ্য সরকারের যাহা আয়, তাহা হইতে বেতন, পেনশন, সুদ, ইত্যাদি আবশ্যিক ব্যয় নির্বাহ করিবার পরে উন্নয়নের খাতে খরচ করিবার জন্য পড়িয়া থাকে শতকরা ছয় টাকারও কম। ভূতপূর্ব অসীম দাশগুপ্তের হিসাব বলিতেছে, উন্নয়নের সংস্থান অনেকটাই বেশি এক বিচারে ২৬ শতাংশ, অন্য বিচারে ৩৭। বুঝ লোক যে জান বাজেট। সূক্ষ্মবিচারে বাঙালির কোনও অরুচি নাই। ভূতপূর্ব জমানাতেও ছিল না, বর্তমান জমানাতেও নাই। রাশিয়া সত্য না চিন সত্য, ভারতীয় বণিকসমাজ জাতীয় পুঁজির প্রতিভূ না মুৎসুদ্দি পুঁজির, ইত্যাকার নানাবিধ বিচারে বাঙালি মহানন্দে নিমগ্ন থাকিয়াছে, ইত্যবসরে পুঁজি পলায়ন করিয়াছে, শিক্ষার মান নীচ হইতে আরও নীচে নামিয়াছে, পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অগ্রণী রাজ্য হইতে পশ্চাৎপদ রাজ্যে পরিণত হইয়াছে। শতাব্দী বদলাইয়া গিয়াছে, নূতন শতকের একটি দশক অতিক্রান্ত, এমনকী বামফ্রন্ট সরকারও বিদায় লইয়াছে, এই বার অন্তত কু-অভ্যাস হইতে বাঙালির মুক্তি আবশ্যক। একটি অবান্তর বিতর্কের কয়েক শতাংশ চুল চিরিতে ব্যতিব্যস্ত না হইয়া মূল সমস্যায় অভিনিবেশ জরুরি। মূল সমস্যা স্পষ্ট এবং বহুচর্চিত: রাজ্য সরকারের সীমিত আয়ের এক বিরাট অংশ শতাংশ যাহাই হউক দৈনন্দিন খরচ মিটাইতে চলিয়া যায়, উন্নয়নের সংস্থান যৎসামান্য। এবং এই সমস্যার দায় যে অসীম দাশগুপ্তের উপর বিপুল পরিমাণে বর্তায়, তাহাও বোধ করি তিনি ধর্মত অস্বীকার করিতে পারিবেন না, কারণ তিনিই তেইশ বছর একাদিক্রমে পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত ছিলেন। অমিত মিত্র তাঁহার পূর্বসূরির কৃতকর্মের দায় বহন করিতেছেন, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই।
কিন্তু অমিতবাবুর তো তাহা অজানা ছিল না। বামফ্রন্ট সরকারকে শেষ অবধি পশ্চিমবঙ্গের ভোটদাতারা অপসারণ করিয়াছেন, তাহা তো ওই সরকারের ব্যর্থতার প্রতিফল। অসীম দাশগুপ্তের ব্যর্থতাও তাহার অঙ্গ। ভোটদাতারা নূতন সরকার চয়ন করিয়াছেন। অমিতবাবু সেই নূতন সরকারের নূতন অর্থমন্ত্রী। তিনি কাঁটার মুকুট পরিয়া কণ্টকাসনে বসিয়াছেন, তাহা ঘটমাত্র। তিনি কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক নীতিকে নূতন পথে চালনা করেন, কী ভাবে কাঁটাগুলিকে একটি একটি করিয়া তুলিয়া সরকারি কোষাগারের স্বাস্থ্য ফিরাইবেন, রাজ্যবাসী তাহাই দেখিতে চাহেন। নূতন সরকারের পাঁচ মাস কাটিয়াছে। এখনও পর্যন্ত সেই নূতন পথের কোনও নির্দেশিকা দেখা যায় নাই, অমিত মিত্রের বাজেট প্রস্তাবে পদ্ধতিগত সংস্কারের কথা অনেক আছে, কিন্তু পদ্ধতি আর নীতি এক নহে। রাজস্ব আদায়ের কুশলতা বাড়াইতে পদ্ধতিগত সংস্কার নিশ্চয়ই আবশ্যক, কিন্তু তাহাতে নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন কমে না।
নীতিগত পরিবর্তন করিতে চাহিলে অর্থমন্ত্রীকে এক দিকে রাজস্ব আদায়ের নূতন উৎস কাজে লাগাইতে হইবে, অন্য দিকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কঠোর হাতে দমন করিতে হইবে। দুইটিই অ-জনপ্রিয় কাজ। বস্তুত, জন-অপ্রিয়। কিন্তু ক্ষমতায় আসিবার প্রথম বছরে অপ্রিয় কাজ করিতে না পারিলে আর কখনও সে কাজ পারিবার ভরসা কম। স্পষ্টতই, তৃণমূল কংগ্রেস তথা তাহার নেত্রীর নীতি জনপ্রিয়তার পথেই অবিচল থাকিতে চাহে। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর কাজ সেই ভ্রান্তি দূর করিয়া নীতিকে যথাযথ পথে প্রতিষ্ঠিত করা। অসীম দাশগুপ্ত রাজ্য সরকারের কোষাগারের যে হাল করিয়া গিয়াছেন, অমিত মিত্র তাহা ফিরাইতে পারিলেন কি না, ইতিহাস তাহাই বিচার করিবে। তিনি পূর্বসূরির সহিত শতাংশের সূক্ষ্মবিচারে কয় রাউন্ড জিতিলেন, তাহা কেহ মনে রাখিবে না। |