|
|
|
|
|
|
|
শেষের সে দিন |
অনেকের ভয়ঙ্কর, আবার অনেকের নয়। কারও দেহ জনতার রোষে হয় ছিন্নভিন্ন।
কেউ বা মুরুব্বি পাকড়ে জোগাড় করে নেন নিরাপদ বিলাস-আশ্রয়।
সাত লক্ষ খুন হয় মাফ! লিখছেন গৌতম রায়
|
লিবিয়ার একনায়ক মুয়াম্মর গদ্দাফি নিহত হলেন। ২০১১-র আরব বসন্ত থেকে মুছে গেল জুঁই ফুলের সৌরভ। তার বদলে সেখানে এখন রক্ত ও মৃত্যুর উৎসব। এ উৎসব অবশ্য ইয়েমেনেও অবিরত রক্ত ঝরাচ্ছে। বিদ্রোহীদের বোমার আঘাতে সেখানে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে, আহত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট নিজেও। তবে ঘটমান আরব বসন্তে গদ্দাফিই প্রথম নিহত একনায়ক। তাঁর আগে অবশ্য সাদ্দাম হুসেনও একই ভাবে ‘ইঁদুরের গর্ত’ থেকেই ধরা পড়েন। তবে সাদ্দামকে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার থেকে টেনে-হিঁচড়ে বার করেছিল ইরাকে দখলদার মার্কিন সেনারা। মাথার উপর ন্যাটোর বোমারু বিমানবহরের নিরাপত্তার ছত্রছায়ায় গদ্দাফির স্বদেশবাসীই তাঁকে তাঁর জন্মস্থান সির্তে-র নর্দমা থেকে টেনে বের করে এনে খুঁচিয়ে মারেন।
ঠিক ইঁদুরের গর্ত না হলেও পরাজিত, পলায়নপর, ছদ্মবেশী বা আত্মগোপনকারী একনায়কদের জনরোষের বলি হওয়ার কিংবা জনরোষ এড়াতে আত্মঘাতের ঘটনা ইতিহাসে কম নেই। রোমানিয়ার সস্ত্রীক চাওসেস্কু, ইতালির স-রক্ষিতা মুসোলিনিকে জনতার যে তীব্র ঘৃণার মধ্য দিয়ে মরতে হয়েছে, গদ্দাফির মৃত্যুতেও সেই একই ঘৃণা, ক্রোধ ও নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করা গেছে।
ব্যতিক্রম কেবল হিটলার। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল (মুসোলিনির হত্যার ঠিক দু’দিন পরে) বার্লিনের একটি বাঙ্কারে একটাই গুলির আওয়াজ ভেসে আসে ফুয়েরারের পড়ার ঘর থেকে। লাল ফৌজের বৃত্ত তাঁর চার পাশে ছোট হয়ে আসছে জেনে আর অপেক্ষা করেননি হিটলার। দীর্ঘ দিনের সহগামিনী, সদ্য বিবাহিতা ইভা ব্রাউনকে সায়ানাইড সংযোগে আত্মঘাতে প্ররোচিত করে বিশ্বস্ত অনুগামীদের আদেশ দেন তাঁদের মৃতদেহ রুশ ফৌজের দ্বারা অসম্মানিত হওয়া থেকে বাঁচাতে কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়ার। ফুয়েরারের মতাদর্শগত গুরু মুসোলিনির মৃতদেহের সে-সৌভাগ্য জোটেনি, জনতার যথেচ্ছ থুথু-লাথির পর কসাইখানার মৃত গরু-শুয়োরের মতো দেহটিকে গোড়ালি থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, প্রকাশ্যে। মুসোলিনি বা চাওসেস্কু মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে যত অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন, গদ্দাফি তার একাংশও করেননি। তবু তাঁর উপরেও আছড়ে পড়ল একই রকম জনরোষ। গত কয়েক মাস ধরেই অবশ্য বিদ্রোহীদের সাফল্য এবং গদ্দাফির পরাজয় নিয়ে গুজব রটছিল। গদ্দাফি রাজধানী ছেড়ে পালিয়েছেন, তাঁর ছেলে নিহত হয়েছেন কিংবা তাঁর পরিবারকে নিরাপদ প্রবাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এ জাতীয় গুজব ছড়াবার পরেই তাঁর মুখ টেলিভিশনে ভেসে উঠত কিংবা বেতারে বক্তৃতা শোনা যেত, যাতে অনুগামীদের মনোবল না হারিয়ে লড়ে যাওয়ার আহ্বান, বিদ্রোহীদের মোক্ষম শাস্তি দেওয়ার আস্ফালন থাকত। মনে পড়ে যেত, গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাসের কথা।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাস ‘অটাম অব আ পেট্রিয়ার্ক’ রাজনৈতিক স্বৈরাচারের অমরত্ব অর্জনের এক অনবদ্য রূপক, যেখানে পরিপক্ব হেমন্তে পৌঁছেও কুলপতির সার্বভৌম কর্তৃত্বের অবসান হয় না। স্বৈরতন্ত্রী সেখানে মরেও মরেন না। তাঁর মৃত্যু-সমাচার দেশময় প্রচারিত হওয়ার পর দিনই বেতারে গমগম করে তাঁর কণ্ঠস্বর ঘাতকদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়ার অকম্পিত বজ্রমন্দ্র কণ্ঠ, যা দেশবাসীকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে, কুলপতি কুশলে আছেন, চক্রান্তকারীরা তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি, অতএব দেশবাসীও অনাথ হয়নি। তাই অবশেষে এক দিন যখন সত্যি-সত্যিই তাঁর নশ্বর দেহান্ত ঘটে, দেশবাসী সে-খবর বিশ্বাস করতেই চায় না। ভাবে এটাও আগের খবরগুলোর মতোই বিভ্রমসৃষ্টিকারী একটা চাল কারা এই মৃত্যুসংবাদে উল্লসিত, উৎসবমুখর হচ্ছে, তাদের শনাক্ত করার কূটকৌশল। অচিরেই আবার টেলিভিশনের পর্দায় নিশ্চিত ভেসে উঠবে কুলপতির অবিনশ্বর কর্তৃত্বের মুখচ্ছবি। গার্সিয়া মার্কেসের এই রূপক স্বৈরাচারের অবিনশ্বরতার, নব-নব রূপে নিজেকে পুনরুদ্ভাবনের লাতিন আমেরিকান বাস্তবতার অপ্রস্তুত প্রশংসা, যা অনায়াসেই ভূগোলের পরিসর অতিক্রম করে সর্বজনীন আন্তর্জাতিকতায় উত্তীর্ণ। কেননা বিশ্ব জুড়েই স্বৈরতন্ত্রের অনিঃশেষ নিরবচ্ছিন্নতার দিনলিপি রচিত হয়ে চলেছে আবহমান। ইতিহাসে স্বৈরাচারীর মৃত্যু বা অপসারণের দিনক্ষণ নথিভুক্ত থাকলেও জনসাধারণের অভিজ্ঞতায় স্বৈরতন্ত্র একটি অমরত্বের আখ্যান। সেই আখ্যানবৃত্তে একদা ফ্লরিডার অতলান্তিক পারের মায়ামি সৈকতের যে ভূমিকা ছিল কিংবা ভূমধ্যসাগরতটের ফরাসি রিভিয়েরার, আজ সৌদি আরবের মরূদ্যানও সেই ভূমিকা পালন করছে। গত শতাব্দীতে মায়ামি সৈকতে ভর-সন্ধেবেলা হেঁটে বেড়ালে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দু’চার জন গদিচ্যুত স্বৈরশাসকের দেখা পাওয়া মামুলি ব্যাপার ছিল। কিউবার হেরার্দো মাচাদো ও বাতিস্তা, গুয়াতেমালার গিলবের্তো ইয়োর্দান, হাইতির প্রসপার অ্যাভ্রিল, পেরুর রিকার্দো উর্তাদো, নিকারাগুয়ার আনাস্তাসিয়ো সোমোসা, হন্ডুরাসের এর্নান্দেস লারা, বলিভিয়ার কার্লোস সাঞ্চেস এঁরা সকলেই মার্কিন প্রশাসনের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারকে বরখাস্ত করে নিজ-নিজ দেশে হত্যা ও ধর্ষণের অভিযান চালিয়েছিলেন। সি আই এ এবং মার্কিন নৌ-সেনার নিরাপত্তা-বলয়ে দাঁড়িয়ে, দরিয়ায় মার্কিন রণতরী নোঙর করিয়ে যেমন লক্ষ-লক্ষ প্রতিবাদীকে হত্যা করেছিলেন এল সালভাদর ও পানামার একনায়করা। পরে দেশবাসীর কাছে লাথি-খাওয়া এই একনায়কদেরই বার্ধক্যের বারাণসী হয়ে ওঠে মায়ামির সৈকত। একই ভাবে রিভিয়েরার সমুদ্র-সৈকতও জ্বলজ্বল করতো সাবেক ফরাসি উপনিবেশগুলির ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারীদের লুঠ-করে-আনা বৈভবের ঝলকানিতে। কিছু একনায়ক আবার সুইট্জারল্যান্ডের লেক জেনিভার ধারে কিংবা লন্ডনের বেলগ্রাভিয়া অঞ্চলে আগাম কিনে রাখতেন তাঁদের দুঃসময়ের আশ্রয়। এখন উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম দুনিয়ায় স্বৈরতন্ত্রবিরোধী গণবিক্ষোভের কাল। তাই মুসলিম রাষ্ট্রের বিতাড়িত স্বৈরশাসকরা সৌদি রাজার আতিথেয়তায় আশ্রিত। তবে দিনকাল পাল্টেছে। গদিচ্যুত স্বৈরাচারীদের আগের মহিমা ও জৌলুস এখন নেই। ১৯৯০ সালের পর থেকে মোট ৯২ জন স্বৈরশাসককে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট ছিনে জোঁকের মতো পিছনে লেগে থাকায়। ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘যুদ্ধাপরাধ’ ইত্যাদি মামলায় অভিযুক্ত করে আশ্রয়দাতা রাষ্ট্রগুলিকে চাপ দিচ্ছে বা বাধ্য করছে স্বৈরাচারীদের প্রত্যর্পণ করতে, কৃতকর্মের বিচারের জন্য। গদিচ্যুত স্বৈরাচারীরা আর তত সুখে নেই।
সভ্য পৃথিবীর নিয়মকানুন অবশ্য সৌদি আরবে খাটে না। আন্তর্জাতিক আদালতের চাপও ওখানে পৌঁছয় না। তাই ইদি আমিনের মতো মানুষখেকো জল্লাদ উগান্ডায় তাঁর বীভৎস স্বৈরাচারের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমতাচ্যুত হয়েও কেবল ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সুবাদে সৌদি প্রাসাদে তিন দশক ধরে নির্বাসিত জীবন বিলাসে-বৈভবে কাটিয়ে দিতে পারেন, সস্ত্রীক এবং আমৃত্যু। দেশের ব্যাংকগুলি থেকে দেড় টন সোনা লুঠ করে নিয়ে টিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলির স্ত্রী লায়লা ত্রাবেল্সিও অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারেন লোহিত সাগর তীরবর্তী জেড্ডা শহরের প্রাসাদে। খানিক পরে পৌঁছে সেখানে সাদর সংবর্ধনা পান বেন আলিও। পান যত দিন খুশি দেশবাসীর ঘৃণা থেকে লুকিয়ে থাকার ছাড়পত্রও। ইয়েমেন যখন টিউনিসিয়ার মতোই গণতন্ত্রের দাবিতে উত্তাল হল, তখন সৌদি রাজকুমাররা সেখানকার শাসক আলি আবদুল্লা সালেকেও পত্রপাঠ চলে আসতে বলেছিলেন। অভিন্ন সীমান্ত অতিক্রম করতে সালেকে বিমান ধরতেও হত না। কিন্তু এত দীর্ঘ কাল ইয়েমেনিদের সামরিক বুটের তলায় রাখা সালে বিশ্বাস করতে পারেননি, ওরা এত অনমনীয় বিদ্রোহী হবে। তাঁর প্রাসাদ যখন অন্তর্ঘাতকের বোমায় কেঁপে উঠল, সপরিবারে আহত হলেন, সর্বাঙ্গ পুড়ে গেল বোমার আগুনে ও টুকরোয়, তখন আর দেরি কীসের। চললেন তিনি সৌদি প্রাসাদের অভিমুখে। বিলাসবহুল একটি ভিলা তাঁর অপেক্ষাতেই সাজিয়ে রাখা ছিল। হোসনি মুবারককেও যে মিশরের গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের পর সৌদি আরবে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে, এটা কেউ ভাবেনি। মুবারক নিজে তাঁর সেনাকর্তাদের ওপর ভরসা রেখেছিলেন। তারাও যখন জনতার পক্ষ নিল, তখন তিনি ইচ্ছা থাকলেও সৌদি রাজার আতিথ্য গ্রহণে অপারগ। কেননা পালাবার সব রাস্তা জনতা বন্ধ করে দিয়েছে তত দিনে। বেন আলির মতো তারা মুবারককে বেকসুর ক্ষমা করবে না, তাঁর বিচার করে ছাড়বে। না হলে সৌদি আরবকে আরও একটা রাজপ্রাসাদ ঝাড়পোঁছ করে তৈরি রাখতে হত। প্রতিক্রিয়াশীল একনায়কদের আশ্রয় দেওয়ার সৌদি ঐতিহ্য তো আজকের নয়। ১৯৪০-এর দশকেই ইরাকের নাত্সিপন্থী শাসক রসিদ আলি আল গায়লানি প্রথমে পালিয়ে গিয়ে বার্লিনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু হিটলারের মৃত্যুর পর বেচারা অনাথ হয়ে যান। তখন কে তাঁকে আশ্রয় দেবে সৌদি আরব ছাড়া? নওয়াজ শরিফের মতো শাসকরাও তো দেশ থেকে নির্বাসিত হলে সৌদি রাজার আলখাল্লার তলায় গিয়েই লুকোতে ভালবাসেন। তবে লিবিয়ার মুয়াম্মর গদ্দাফির জন্য সৌদি আতিথেয়তা বোধ হয় তত অকৃপণ হত না। সৌদি শাসকদের সঙ্গে গদ্দাফির বরাবরের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। আর সেটা জানতেন বলেই তিনি নাইজিরিয়ার মতো কোনও অতিথিশালা হাতড়াচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে তাঁর বন্দরের কাল শেষ হয়ে এল। এসে গেল নোঙর ছেঁড়ার ডাকও।
অথচ কী সুখেই না কেটেছে কত কাল! একনায়কদের অবসরজীবন প্রায়শ কর্মজীবনের চেয়ে দীর্ঘতর এবং বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। বার্ধক্যের বারাণসীকে তাঁরা প্রায়শ যৌবনের উপবনে পরিণত করেছেন। চিলির পিনোশে, লাইবেরিয়ার চার্লস টেলর, কেনিয়ার ড্যানিয়েল অ্যারাপ ময়, ফিলিপিন্সের মার্কোস, যুগোস্লাভিয়ার মিলোসেভিচের মতো স্বৈরতন্ত্রীরা শুধু সুইস ব্যাংকেই ১৪ হাজার কোটি ডলার লুঠ-করা দেশীয় সম্পদ জমা করেছিলেন। বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার শেয়ার, সোনার বাট, জমি-জমাতেও লগ্নি করেছিলেন আরও হাজার-হাজার কোটি। গদ্দাফি ও সাদ্দামের কপাল মন্দ, বাকিরা তো চুটিয়ে ভোগ করেছে ওই লুণ্ঠিত সম্পদের বিনিময়ে লভ্য জাগতিক সুখ-সমৃদ্ধি। মাঝে-মধ্যে অপসারিত স্বৈরাচারীর দেশবাসী গণতন্ত্রপ্রেমী মুক্ত দুনিয়ার কাছে ওই লুণ্ঠিত সম্পদ ফেরত চাইলে তা ‘আটকে দেওয়া’র আশ্বাস দেওয়া হয় বটে। তবে দেখা গেছে, সঞ্চিত সম্পদের মাত্র পাঁচ শতাংশই এ ভাবে আটকে দেওয়া হয়, তার বেশি নয়। বাকিটা স্বৈরাচারীরা তাদের স্ত্রী, রক্ষিতা নিয়ে আগের মতোই দিব্যি ভোগ করে চলেন, যদি অবশ্য তাঁরা সময়মতো পালাতে পারেন। সে জন্য তাঁদের বাসভবনের কাছেই ব্যক্তিগত জেট বিমান তৈরি থাকে। এক বার তাতে চড়ে বসতে পারলে দেশান্তরের সাগরবেলার বিলাসবহুল বাংলো হাতছানি দিতে থাকে, ব্যাংকে গচ্ছিত কোটি-অর্বুদ রজতমুদ্রা বিলাসব্যসনে ডুবে থাকার উপকরণ জোগায়। ফেলে-আসা স্বদেশের জন্য তখন আর তত মন-কেমনও করে না।
আরব মুলুকে এখন স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণ-বিক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে, কখনও বা বিস্ফোরিত। গদিচ্যুত হচ্ছেন স্বৈরাচারীরা। অসুস্থ হয়ে পড়ায় পালাতে পারেননি মিশরের গদিচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক। কিন্তু টিউনিসিয়ার শাসক জিনে আল আবিদিন বেন আলি তাঁর চব্বিশ বছরের সাধের রাজত্ব ছেড়ে সটান সৌদি আরবের জেড্ডায় উপস্থিত। জামাই আদরে তাকে সেখানে রেখেছেন সৌদি রাজা। বেন আলির দ্বিতীয় স্ত্রী লায়লা সম্ভবত আগেই তাঁর পতিভাগ্য আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই দুবাই হয়ে সৌদি আরবে পালানোর আগেই তিনি দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে পৌনে চার কোটি পাউন্ড মূল্যের সোনার বাট সরিয়ে ফেলেছিলেন। নির্বাসিত জীবনে খাওয়া-পরার অভাব বেন আলির হবে না। যেমন হয়নি উগান্ডার ইদি আমিন বা পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফের। দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ওঁরা সৌদি রাজার আশ্রয়ে থেকেছেন। ইদি আমিনের পঞ্চম স্ত্রী সারা কিয়োলাবা যে নির্বাসিত স্বামীর সৌভাগ্যের অংশীদার হতে পারেননি, তার কারণ, তাঁর সঙ্গে স্বামীর বিচ্ছেদ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত জার্মানিতে মহিলাদের নৈশ অন্তর্বাসের মডেল হয়ে আর লন্ডনে চা-কফির দোকান চালিয়ে তাঁকে নিজের খোরাকি উপার্জন করতে হয়। বেনিতো মুসোলিনির ধর্মপত্নীকেও নিজের দেশের বাড়িতে পাস্তার রেস্তোরাঁ চালিয়ে পেট চালাতে হতো। পার্টিজানরা মুসোলিনির রক্ষিতা ক্লারেত্তা পেতাচ্চিকে তাঁর সঙ্গেই হত্যা করেছিল। তবে তাঁর বেচারা স্ত্রী র্যাচেলে গুইদিকে রেহাই দেয়। ভাগ্যিস একনায়কের রসনা তৃপ্তির জন্য তিনি রান্নাবান্নাটা ভালমতো শিখে রেখেছিলেন! রুমানিয়ার স্বৈরতন্ত্রী নিকোলাস চাওসেস্কুর স্ত্রী এলিনা অত ভাগ্যবতী ছিলেন না। চাওসেস্কুর উপর সঞ্চিত জাতক্রোধ এতই তীব্র ছিল যে তাঁর নিরীহ স্ত্রীকেও বিদ্রোহীরা রেয়াত করেনি। হেলিকপ্টারে চড়ে পালাবার সময় এত কালের অনুগত সেনাবাহিনীর একাংশই মাটিতে কপ্টার নামাতে বাধ্য ক’রে সস্ত্রীক চাওসেস্কুকে হত্যা করে।
ক্যারিবীয় দ্বীপ হাইতি একদা ফরাসি উপনিবেশবাদীদের নির্যাতন-শিবির ছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষাশেষি প্রজাবিদ্রোহ সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের প্রজাতন্ত্র কায়েম করে। ইতিহাসে প্রথম। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ শাসকরাও কালক্রমে তাঁদের স্বজাতীয়ের প্রতি কী ধরনের উৎপীড়ক হয়ে ওঠেন এবং পরিণামে আরও এক দফা বিদ্রোহে তাঁদের উৎখাত হতে হয়, কিউবান ঔপন্যাসিক আলেহো কার্পেন্তিয়ের তাঁর ‘কিংডম অব দিস ওয়ার্ল্ড’ উপন্যাসে তার মর্মস্পর্শী কাহিনি বর্ণনা করেছেন। স্বৈরতন্ত্র এ ভাবেই ঘুরে-ঘুরে আসে। জারের স্বৈরাচার উৎখাত করে স্তালিনের স্বৈরাচার কায়েম হয়, চিয়াং কাই শেক-এর স্বৈরাচার সরিয়ে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির দলীয় একনায়কতন্ত্র। হাইতির স্বৈরাচারী ‘পাপা ডক’ দুভালিয়ের ও তাঁর কুখ্যাত সিক্রেট পুলিশ-রাজের অবসানে তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী ‘বেবি ডক’ দুভালিয়ের নির্মম অত্যাচারে দেশবাসীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। এ সবেরই সবিস্তার বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে গ্রাহাম গ্রিন-এর উপন্যাস ‘দ্য কমেডিয়ান্স’-এ। পাপা ডক-এর দুঃস্বপ্নসম্ভব খুনি প্রজাতন্ত্র তার রোমহর্ষক পীড়ন-আখ্যান নিয়ে ভয়ঙ্কর ভাবে উপস্থিত হয় গ্রিনের রচনায়। ১৯৮৬ সালে এই ‘বেবি ডক’ জাঁ ক্লদ দুভালিয়ের ক্ষমতাচ্যুত হলে রিভিয়েরার সৈকতে তাঁকে সাদরে আতিথেয়তা দেয় ‘সাম্য-স্বাধীনতা-সৌভ্রাত্র্য’-এর আদর্শে নিষ্ঠ গণতান্ত্রিক ফ্রান্স। খেতে-না-পাওয়া সর্বহারার দেশ হাইতির এই স্বৈরাচারীর বিয়েতেই খরচ হয়েছিল ৩০ লক্ষ ডলার, ফরাসি কন্যা মিশেলে বেনেত-এর সঙ্গে। হাইতি থেকে এই দম্পতি ইউরোপীয় ব্যাংকে কোটি-কোটি ডলার পাচার করতে থাকে, যা পরবর্তী কালে রিভিয়েরায় ফেরারি-পরিবৃত বিলাসবহুল ভিলায় বসবাস করতে সাহায্য করবে। নির্বাসিত দুভালিয়ের দম্পতির গেরস্তালি খরচের একটা হিসেবের খাতা হাতে পেয়ে ফরাসি পুলিশের চক্ষু চড়কগাছ হয়েছিল, যাতে মিশেলের পোশাক কেনার জন্য এক লক্ষ সত্তর হাজার এবং গয়না কিনতে দু’লক্ষ সত্তর হাজার ডলারের খরচ ধরা ছিল। পশ্চিম গোলার্ধ্বের দরিদ্রতম এই দেশের লুণ্ঠিত বিপুল সম্পদও অবশ্য বেচারা দুভালিয়ের পুরোটা একা ভোগ করতে পারেননি। তাঁর ফ্যাশনদুরস্ত ফরাসি স্ত্রী বিয়ের দশ বছরের মধ্যেই বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ইউরোপীয় ব্যাংকে গচ্ছিত হাইতির অধিকাংশ সম্পদের ভাগ নিয়ে কেটে পড়েন।
‘বলকানের জল্লাদ’ স্লোবোদান মিলোসেভিচ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে বিচারের জন্য ‘দ্য হেগ’-এ আনীত হলে তাঁর হৃদ্যন্ত্র সহসা বিকল হয়ে পড়ে। শাস্তি পাওয়ার আগেই এই ভাগ্যবান মারাও যান। কিন্তু তাঁর করিৎকর্মা স্ত্রী মির্জানা ইতিমধ্যে দামি ব্র্যান্ডের সিগারেটের চোরাচালান করে বহু লক্ষ পাউন্ড হস্তগত করে ফেলেছেন, সার্বিয়ার বর্তমান সরকার যা ফেরত চায়। কিন্তু মির্জানার আবার দামি ফারের পোশাক এবং ফরাসি সুগন্ধি বড় পছন্দ। তা ছাড়া, নাক-চোখ-ঠোঁট জায়গা মতো বসানোর জন্য তাঁকে মাঝেমধ্যেই ইতালি থেকে বিশ্বস্ত কসমেটিক সার্জনকে বিমানে উড়িয়ে আনতে হয়। টাকাটা তাঁর দরকার। রাশিয়ার আশ্রয়ে তিনি তাই বহাল তবিয়তে আছেন। ইথিওপিয়ার মেঙ্গিত্সু হাইলে মরিয়ম যেমন আছেন জিম্বাবোয়েতে প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের নিরাপদ আশ্রয়ে। ১৯৯১ সালে গদিচ্যুত হওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর ১৭ বছরের স্বৈরাচারে দশ লক্ষ ইথিওপীয় গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু তা বলে মুগাবের আনুকূল্যে জিম্বাবোয়ের রাজধানী হারারে ও লেক কারিবায় দুটি বিলাসবহুল ভিলায় সস্ত্রীক ব্যসনে ডুবে থাকতে মেঙ্গিত্সুকে কে-ই বা বাধা দেবে? তাঁর চেয়েও বেশি বিলাসী জীবন অবশ্য কাটিয়েছেন ৩২ বছর ধরে জাইরেতে স্বৈরাচার চালানো মবুতু সেসে সেকু ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ববি লাদাওয়া। ১৯৯৭ সালে যখন তাঁরা ক্ষমতাচ্যুত হন, তত দিনে মবুতু জাইরে থেকে সাড়ে ছশো কোটি পাউন্ড সরিয়ে ফেলেছেন। মরক্কোয় তাঁরা দিব্যি আশ্রয়ও পেয়ে যান।
ফিলিপিন্সে ফার্দিনান্দ মার্কোসের অত্যাচার ও শোষণের কথা এশিয়ায় বহুবিদিত। ১৯৮৬ সালের গণ-অভ্যুত্থানে মার্কোস দম্পতি দেশ ছেড়ে পালানোর পর জনতা তাঁদের প্রাসাদে গিয়ে দেখে, মার্কোস-পত্নী ইমেল্ডা এক হাজার জোড়া ফ্যাশনদুরস্ত জুতো এবং দশটি বহুমূল্য মিঙ্ক কোট ফেলে গেছেন। মার্কোস কয়েকশো কোটি পাউন্ড অন্যত্র পাচার করে রেখেছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন আদর করে তাঁদের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের হনলুলুতে আশ্রয় দেন। মার্কোসের মৃত্যুর পর ইমেল্ডা অবশ্য ফিলিপিন্সে ফিরে আসেন নতুন করে ক্ষমতা দখলের আশায়। ইমেল্ডা অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রয়াসে সফল হননি। তবে কৃতকর্মা প্রয়াত স্বামীর দৌলতে তাঁরও খাওয়া-পরার অভাব নেই।
মার্কোসের মতোই আর এক স্বৈরাচারী নিকারাগুয়ার আনাস্তাসিয়া সোমোসাও ’৭৯ সালের সান্দিনিস্তা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে মায়ামিতে আশ্রয় চান তাঁর এত কালের পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! দেশে-দেশে অনুগত একনায়কদের চাষ করা আমেরিকা তাঁর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়। তা বলে সোমোজার জন্য স্বৈরাচারখচিত লাতিন আমেরিকায় বাড়িভাড়া পাওয়া যাবে না, তা কেমন করে হবে? প্যারাগুয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়। তবে বছরখানেকের মধ্যেই গুপ্তঘাতকের হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়। |
|
উপনিবেশবাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই প্রায় ক্রীতদাস-প্রথার মতোই নিন্দনীয় হয়ে ওঠে। অথচ প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ তৃতীয় বিশ্বের শোষণ চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ তো থেমে থাকতে পারে না। দেশে-দেশে তাই পুতুল সরকার কায়েম হয়, যার প্রধানরা মার্কিন ও ইউরোপীয় পুঁজি ও বাণিজ্যের স্বার্থে স্বদেশের সম্পদ উজাড় করে দিতে থাকে। এর প্রতিবাদ দমন করতে যে-সব যন্ত্রপাতি ও সাজসরঞ্জাম লাগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা সরবরাহ করে। তাতে বলীয়ান হয়ে তৃতীয় বিশ্বের একনায়করা মার্কিন ও ইউরোপীয় পুঁজির কাছে নিজের দেশ ও সম্পদ বিলিয়ে দেয়। এ ভাবেই তৃতীয় বিশ্বের লোহা, ইস্পাত, ম্যাঙ্গানিজ, বক্সাইট, টিন, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস, ইউরেনিয়াম, সোনা ও হিরে পাচার হতে থাকে। সেই সরকারি পাচার-কাণ্ডে পৌরোহিত্য করতে এগিয়ে আসে পশ্চিমী শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু মুৎসুদ্দি শ্রেণির আমলা, ডাকাত-পুঁজিপতি ও অর্ধশিক্ষিত ভাগ্যান্বেষী গোষ্ঠী-সর্দার। এরাই পিনোশে, সোমোজা, স্ট্রোয়েসনার, বাতিস্তা। এরাই মবুতু, দুভালিয়ের, মেঙ্গিত্সু। এরাই হোসনি মুবারক, বেন আলি, গদ্দাফি।
এঁদের অনেকেরই রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরু হয় জাতীয়তাবাদী হিসাবে, এমনকী বিপ্লবী হিসাবেও। কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো কিংবা ভেনেজুয়েলার উগো সাঞ্চেস যেমন ক্ষমতাসীন হয়েই বিদেশি ও মুৎসুদ্দি পুঁজির জাতীয়করণ করেছিলেন। সমাজতন্ত্র, নিদেনপক্ষে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি চালু করেছিলেন। দেশজ সংস্কৃতির উপাদান ও প্রতীকগুলিকে সযত্নে নিজেদের গণভিত্তি প্রসারের কাজে ব্যবহারও করেন। প্রথম দিকে এঁদের ক্রিয়াকর্মে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, দেশপ্রেম, প্রজাকল্যাণ ও জাতীয়তাবাদের প্রাবল্যও থাকে। পরে ক্ষমতায় থাকতে-থাকতে ক্রমশ তাঁরা স্বার্থপর, স্বৈরাচারী, নিরাপত্তা-সচেতন, জনতা-ভীরু হয়ে ওঠেন।
দুই বর্ণময় একনায়কের একজন কাস্ত্রো বর্তমানে অবসৃত, ভাই রাউলের হাতে রাজ্যপাট ন্যস্ত করে অশীতিপর দিনযাপনের আয়াশে এলিয়ে রয়েছেন। সক্রিয় ক্ষমতায় থাকার সময় তাঁকে হত্যা করতে অন্তত ৬৩৮টি ষড়যন্ত্র একা সি আই এ-ই রচনা করেছিল, যার প্রতিটিই, বলা নিষ্প্রয়োজন, ব্যর্থ হয়। তবে এ সংক্রান্ত বিবিসি-র চ্যানেল-৪-এর তথ্যচিত্রটি রয়ে গেছে। একটি ষড়যন্ত্রে কাস্ত্রোর এক প্রাক্তন প্রেমিকাকে সি আই এ ভাড়া করেছিল, যে নিজের মুখে মাখার ক্রিমের কৌটোয় বিষের বড়ি লুকিয়ে কাস্ত্রোর প্রাসাদে যায়। ক্রিমের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বড়িগুলো গলে যায়। প্রেমিকাটি কাস্ত্রোর মুখে-ঠোঁটে সেই ক্রিম মাখাবার ছলে ষড়যন্ত্র সফল করতে চায়নি, হয়তো পুরনো প্রেম চাগিয়ে উঠেছিল। কাস্ত্রো কিন্তু মেয়েটির মতলব ধরে ফেলেছিলেন। ল্যাটিন প্রেমিকের মতোই নিজের গুলি-ভরা রিভলভার প্রেমিকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বুক চিতিয়ে বলেছিলেন এ বার মারো আমায়। মেয়েটি পারেনি। অন্য জন সাঞ্চেস কাস্ত্রোর সাক্ষাৎ ভাবশিষ্য ও চেলা রূপে নিজেকে জাহির করতে যত ভালবাসেন, ততটাই উপভোগ করেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মঞ্চে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ঠোকরাতে, প্রকাশ্যে হেনস্থা ও অপদস্থ করতে। এতে তৃতীয় বিশ্বের বামপন্থীদের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি ‘বিপ্লবী’ চেহারা পায়। স্বৈরক্ষমতার মঞ্চ থেকে সদ্য অপসারিত লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মর গদ্দাফিও দেশের তেল কোম্পানিগুলির জাতীয়করণ করে আরব মুলুকে বেশ বিপ্লবী সেজেছিলেন। তিনি আবার নিজের বেদুইন সত্তাটিকে ভুলতে চাননি। নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের সভায় যোগ দিতে গেলেও সহসা পাঁচ-তারা হোটেল-বিলাসে লিপ্ত হতেন না, খোলা আকাশের নীচে তাঁবু খাটিয়ে তার ভিতর বাস করতেন তাঁর একান্ত নিজস্ব মহিলা দেহরক্ষী-দল পরিবৃত হয়ে।
লিবিয়া যখন প্রজাবিদ্রোহে টালমাটাল, ন্যাটোর গণতান্ত্রিক বোমাবর্ষণে যখন গদ্দাফির স্বৈরাচারের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল, তখন অবশ্য তিনি আর এ সব ঢঙ করেননি। পরিবারকে নাইজিরিয়ার নিরাপত্তায় পাঠিয়ে নিজেও গর্তে লুকিয়ে পড়েন।
জাতীয়তাবাদ, প্রগতি ও আধুনিকতার প্রবক্তা হিসাবে কেরিয়ার শুরু করেও অনেক নায়কই ক্রমে স্বৈরতন্ত্রী হয়ে উঠেছেন। তখন তাঁদের শাসিত প্রদেশ হয়ে উঠেছে গণতন্ত্রী ও স্বাধিকারকামীদের বধ্যভূমি, মাইল-মাইল রক্ত ও মৃত্যুর আযোজন পঙ্কশয্যা, বেপরোয়া জল্লাদের হা-হা উল্লাসমঞ্চ। প্রতিবাদীরা সেখানে ‘অদৃশ্য’ হয়েছে, তাদের ছবি নিয়ে রাস্তায় হাঁটা মা-বাবা-ভাই-বোনেরা পুলিশের লাঠি-গ্যাস-গুলির ঝাপটা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। আস্ত জনপদ লোপাট হয়ে গেছে। স্কুলগামী বাসের শিশুরা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। প্রসূতিদের টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করতে, প্রতিরোধের ব্যারিকেড চূর্ণ করতে। এক স্বৈরাচারী গিয়ে অন্য স্বৈরাচারী এসেছে। এত মসৃণ নিরবচ্ছিন্নতায় যে, মনেই হয়নি সত্যি-সত্যিই একনায়কের মৃত্যু হয়েছে বা হতে পারে কখনও। মনে হয়, এখনই বুঝি রেডিয়োয় বেজে উঠবে তাঁর কণ্ঠস্বর, টেলিভিসনের পর্দায় তাঁর মুখ নড়ে উঠবে জনগণকে আশ্বস্ত করতে যে, আমি মরিনি, কেননা স্বৈরাচারীরা কখনও মরে না। যদি মরেও কিংবা পালিয়েও যায়, তবু স্বৈরাচার থেকেই যায়, নতুন রূপে, নতুন সাজে ফিরে আসতে।
রাজা আসে, রাজা যায়... শুধু মুখোশের রঙ আর পোশাকের ঢঙ বদলায়। |
|
|
|
|
|