অসুবিধেটা হচ্ছিল অন্তত মাস চারেক ধরে।
জুতোর ফিতে বাঁধতে গিয়ে মনে হতো, হাত
যেন সরছে না। ঢাকুরিয়ার অনন্ত দত্ত ধরেই নিয়েছিলেন, তাঁর হাতে বাত হয়েছে। আজ
যাব-কাল যাব করে ডাক্তারের কাছে আর গিয়ে
উঠতে পারেননি।
যে গাফিলতির খেসারত খুব বেশি রকমই
দিতে হল।
এক দিন অফিসে কাজ করতে-করতে আচমকা লুটিয়ে পড়েন বছর পঁয়তাল্লিশের অনন্তবাবু। শরীরের বাঁ দিক পুরো অসাড় হয়ে যায়। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে, উনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী। অথচ কখনও রক্তচাপ মাপেননি! ওষুধও খাননি!
সল্টলেকের চন্দ্রনাথ বিশ্বাস অবশ্য বিলক্ষণ জানতেন, তাঁর উচ্চ রক্তচাপ আছে। তবু রোজ নিয়ম করে ওষুধ খেতেন না। এমনকী, ওষুধপত্র সঙ্গে না-নিয়ে পঁচিশ দিনের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় ছেলের কাছে বেড়াতে চলে গিয়েছিলেন পঁয়ষট্টির ওই বৃদ্ধ। ছেলেকেও এ ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ জানাননি। বাড়ি ফেরার পরে এক রাতে বসার ঘরে অচেতন হয়ে পড়লেন। ডান দিকের সাড়ও চলে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
অনন্তবাবু ও চন্দ্রনাথবাবু দু’জনেই একই শত্রুর শিকার। ব্রেন স্ট্রোক। হার্ট অ্যাটাক সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সম্যক পরিচিত। সেই নিরিখে ব্রেন স্ট্রোক অনেকটাই অচেনা। স্নায়ুরোগের চিকিৎসকেরা অবশ্য জানাচ্ছেন, ব্রেন স্ট্রোকের রমরমা এখন এ দেশে অন্যতম বড় সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র রিপোর্ট বলছে, ভারতে ফি বছর অন্তত ১৭ লক্ষ মানুষ এতে আক্রান্ত হন। মারা যান অন্তত ৬ লক্ষ, ৮ লক্ষাধিক মানুষ বাকি জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান।
এ হেন মারাত্মক রোগ সম্পর্কে আমজনতার সচেতনতার অভাবকেই প্রতিরোধের পথে মস্ত অন্তরায় বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। ব্রেন স্ট্রোক
আসলে কী? |
লক্ষণ |
• হাত-পায়ে অবশ ভাব
• জুতোর ফিতে বাঁধতে সমস্যা
• মুখের অসাড়তা, কথা জড়িয়ে যাওয়া
• বেসামাল হাঁটা-চলা
• ঘাড়ে-মাথায় যন্ত্রণা, বমি, সংজ্ঞা হারানো |
প্রতিরোধ
|
• নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা
• ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ
• ডাক্তারের কথা মেনে নিয়ম করে হাঁটা
• খাদ্যাভ্যাসে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন
• ওজন নিয়ন্ত্রণ |
|
শারীরবিদদের ব্যাখ্যা: হৃদ্যন্ত্রের ধমনীতে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হলে হার্ট অ্যাটাক হয়। আর মস্তিষ্কে রক্তের জোগান কমলে হয় ব্রেন স্ট্রোক। কোনও ধমনী আচমকা ছিঁড়ে গেলে মস্তিষ্কে রক্তপাত হয়। এই ‘সেরিব্রাল হেমারেজ’ই ব্রেন স্ট্রোকের অন্যতম কারণ। আবার কোনও কারণে ধমনী সরু হয়ে মস্তিষ্কের কোনও অংশে রক্ত জমাট বাঁধলেও ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে, ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম ‘সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস।’
সেরিব্রাল হেমারেজ বা থ্রম্বোসিস কোনওটাই কিন্তু একেবারে জানান না-দিয়ে আচম্বিতে আসে না। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, দু’টি ক্ষেত্রেই বেশ ক’দিন আগে থেকে ধমনীতে রক্ত চলাচলে সমস্যা হয়। আর নিয়মিত রক্তচাপ মাপলেই ধরা পড়ে, শরীরের ভিতরে কোথাও না কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে। তবে বিপদের সেই ‘ইঙ্গিত’কে গুরুত্ব না-দেওয়ার প্রবণতাটাই চিকিৎসকদের বেশি ভাবাচ্ছে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে রোগী, রোগীদের পরিজন ও অ-চিকিৎসক কর্মীদের উপরে একটি ‘স্ট্রোক সচেতনতা’ সমীক্ষা চালিয়েছিলেন স্নায়ুরোগের চিকিৎসকেরা। দেখা গিয়েছে, ৬০%-৬৮% মানুষের ধারণা, স্ট্রোক হয় শুধু বুকে (অর্থাৎ হৃদ্যন্ত্রে) হয়। বুক ব্যথা করে। ওঁরা জানেনই না যে, এর সঙ্গে মস্তিষ্কেরও যোগাযোগ থাকতে পারে।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি’র নিউরোমেডিসিনের চিকিৎসকেরা পাঁচ বছর ধরে বারুইপুরের রামনগরে কুড়ি হাজার মানুষের উপরে সাধারণ স্নায়ুরোগ সম্পর্কে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। সমীক্ষকদের অন্যতম চিকিৎসক শঙ্করপ্রসাদ সাহার আক্ষেপ, “স্ট্রোক জিনিসটা কী, সেটা কোথায়, কেন হয়, সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মাত্র ২০%! স্ট্রোকের
হার কমানোর পথে এটাই তো সবচেয়ে
বড় বাধা।”
অন্য দিকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ৯ হাজার স্ট্রোক-আক্রান্তকে নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছে ‘স্ট্রোক ফাউন্ডেশন অফ বেঙ্গল।’ গত ১৩ মার্চ তাঁদের রিপোর্ট ইনদওরে ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশন কংগ্রেস’-এর বার্ষিক অধিবেশনে পেশ হয়েছে। সমীক্ষকদের অন্যতম চিকিৎসক দীপেশ মণ্ডল জানাচ্ছেন, “এ দেশে, বিশেষত এ রাজ্যে যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাঁদের ৫০% সে সম্পর্কে জ্ঞাত নন। যাঁরা জানেন, তাঁদের অর্ধেক আবার চিকিৎসাই করান না, কিংবা নিয়মিত ওষুধ খান না। ফলে স্ট্রোক নিঃশব্দে থাবা বসায়।”
স্ট্রোক সম্পর্কে মানুষের এ হেন ‘অজ্ঞানতা’ই মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন চিকিৎসক নিখিল বিশ্বাসও। তিনি বলেন, “আমাদের এখানে আচমকা কারও ঘাড়ে-হাতে যন্ত্রণা শুরু হলে লোকে ভেবে ফেলবে, শোওয়ার দোষ! মাথা ব্যথা করলে মনে করবে অ্যাসিড। হাত-পা ঝিনঝিন করে অবশ হতে লাগলে ভাববে বাত। কিছুতেই ভাবতে পারবে না যে, এগুলো স্ট্রোকেরও লক্ষণ হতে পারে!”
স্নায়ুরোগ-চিকিৎসক পরিমল ত্রিপাঠীর বক্তব্য, “উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে নিয়মিত হেল্থ চেক-আপ জরুরি। কিন্তু এখানকার অধিকাংশ মানুষ উদাসীন। মধ্যবিত্তদের কাছে হেল্থ চেক-আপ মানে বিলাসিতা। অথচ এটা করলে ফি বছর প্রায় দশ লক্ষ লোক স্ট্রোক এড়াতে পারেন।”
বস্তুত হু-র রিপোর্ট অনুযায়ী ব্রেন স্ট্রোকের আক্রমণ-হার এখন ‘সিক্স-ইন-ওয়ান।’ অর্থাৎ সারা বিশ্বে যেখানেই হোক, ছ’টি মানুষ যদি একত্রিত হন, দেখা যাবে, তাঁদের এক জন না এক জন জীবনে কখনও না-কখনও এই রোগের কবলে পড়েছেন, বা পড়তে পারেন! আর আজ শনিবার, বিশ্ব স্ট্রোক দিবসে স্ট্রোক ফাউন্ডেশন কলকাতায় যে আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছে, তার বিষয়বস্তুও ‘সিক্স ইন ওয়ান।’ ছয়ের মধ্যে এক-এর এই বিপদ সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করাটাই আশু কর্তব্য বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
সচেতনতা এলে প্রতিরোধ তো এমনিতেই গড়ে উঠবে। |