খেলাধুলা...
বাঙালের গতি দর্শন
ই দুনিয়া ঘোরে বনবন বনবন...।
ঘোরা ব’লে ঘোরা। চাকা এমন বনবন করে ঘুরছে যে আট থেকে আশির ‘ছিটকে ছ’ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আর সেই তালিকায় কে নেই? সচিন থেকে সৌরভ, লিয়েন্ডার থেকে সানিয়া, শাহরুখ থেকে হৃতিক, দীপিকা থেকে প্রিয়ঙ্কা, এমনকী রাহুল গাঁধী-সচিন পাইলটও। গোটা দেশের ‘হুজ হু’ নাকি ‘বিগ সানডে’-র অপেক্ষায়। রবিবার যত এগিয়ে আসছে, তত বেড়ে যাচ্ছে টেনশনের পারদ। তর সইছে না কারও। বুনুমাসির ছেলে ক্লাস সেভেনের রুকু নাকি সপ্তাহখানেক ধরেই রাতে ঘুমের মধ্যে কাল্পনিক একটা স্টিয়ারিং ধরে এমন গোঁ গোঁ করে আওয়াজ করছে যে বালকের মস্তিষ্কবিকৃতির সম্ভাবনা নিয়ে বুনুমাসি ছুটছে স্পেশালিস্ট ডাক্তারের কাছে। বাবাকে ব’লে ইডেনে আজ সন্ধের টি-টোয়েন্টির দুটো ক্লাবহাউস আপার টিয়ার জোগাড় করে ফেলেছিল মৌটুসি। ছকটা ছিল ক্লাবহাউসের পাস শুনেই অয়ন হাঁ হয়ে যাবে। উল্টে ফোনটা ধরেই অয়ন কিনা বলল, “সরি রে। বিকেলের ফ্লাইটে ড্যাডির সঙ্গে দিল্লি যাচ্ছি। আই উইল বি ইন বিআইসি টুমরো!”
যে ছেলে ধোনি বলতে অজ্ঞান, বিশ্বকাপ ফাইনালে ছয় মেরে জেতানোর পর ধোনির ব্যাট ঘোরানোর ভঙ্গি কলেজ ক্যান্টিনে নকল করে দেখায়, পরীক্ষা ড্রপ দিয়ে ইডেনে আইপিএল-এ কেকেআর ম্যাচ দেখতে যায়, সে কি না টি-টোয়েন্টি ছেড়ে বিআইসি-তে যাচ্ছে? বি বি এম না হয় ব্ল্যাকবেরি মেসেঞ্জার, কিন্তু বি আই সি-টা কী? খায় না মাথায় দেয়? মৌটুসি বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “বিআইসি-টা আবার কী?”
ফোনে অয়নের গলায় বিরক্তি, “তুই না বড্ড ব্যাকডেটেড হয়ে যাচ্ছিস। কিসস্যু জানিস না। বিআইসি হল বুদ্ধ ইন্টারন্যাশনাল সার্কিট। কাল যেখানে ফর্মুলা-ওয়ান রেস হবে। ইউ নো মাই ড্যাড ইজ আ এফ-ওয়ান ফ্রিক।”
মৌটুসি ঠোঁট বেঁকাল, “ও, তাই বল! ওই তো রবিবার প্রায়ই টিভিতে দেখায়। একগাদা গাড়ি গোঁ গোঁ করে ছোটে। এতে আর আছেটা কী? বোরিং স্টাফ! এর জন্য তুই টি-টোয়েন্টি মিস করছিস?”
অয়ন হাসল, “হ্যাঁ করছি। এফ ওয়ান নিয়ে তোর কোনও আইডিয়াই নেই। বার্সেলোনা বা ম্যান ইউ টিম চালাতে এক সপ্তাহে যা খরচা হয়, একটা ফর্মুলা-ওয়ান গাড়ির পিছনে এক দিনে তা খরচা হয় বুঝেছিস? বিজয় মাল্যর ফোর্স ইন্ডিয়ার নাম শুনেছিস তো? যেটা এখন সহারা ফোর্স ইন্ডিয়া। তা সেই মাল্য কাল বলেছে, বিআইসি-তে কালকের রেসটার পর ইন্ডিয়ার স্পোর্টস কালচারটাই বদলে যাবে!”
রবিবারের বিকেলে নয়ডায় অনুষ্ঠেয় ঐতিহাসিক রেস এ দেশের ক্রীড়া মানচিত্র বদলে দিক বা না দিক, সন্দেহ নেই, এফ ওয়ান ইন্ডিয়ান গ্রাঁ প্রি ভারতের খেলাধুলোর নতুন সীমানা। যা উপড়ে ফেলতে চাইছে যাবতীয় পুরনো ধ্যানধারণার শিকড়, স্বাগত জানাচ্ছে নতুনকে। রাজনীতি, ক্রিকেট, রা-ওয়ান, স্টিভ জোবস পরবর্তী অ্যাপলের পৃথিবী এবং আর যা যা কফির টেবিলে চর্চার বিষয় হতে পারে, সব পিছনে ফেলে এই মুহূর্তে রাজধানীর সব আলোচনা শুষে নিয়েছে এমন এক ক্রীড়ামঞ্চ, যা এ দেশে কেউ কখনও দেখেনি। যা আগে কখনও হয়নি, ক্রিকেটের মতো রোজ রোজ হবেও না। বিশালত্বে, বিনিয়োগে বা ব্যাপকতায় কোনও আইপিএল বা কমনওয়েলথ গেমস যার কাছে লিলিপুট। এই পৃথিবীতে ধোনি ধামাকা নেই, চার-ছয় নেই, দুর্ধর্ষ গোল নেই, অসামান্য পাসিং শট নেই। আছে শুধু অবিশ্বাস্য বিপজ্জনক গতি। থ্রিল। এ এমন এক খেলা, গাড়ি যেখানে জীবনের হাইওয়ে ধরে উল্কাবেগে ছোটে। বিপদকে ভালবেসে বুকে টেনে নিতে না পারলে এ খেলায় প্রবেশাধিকার নেই। নিন্দুকরা যতই বলুক, এ দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়ে চলা গাড়ির বাজার ধরতেই ফিয়া (ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল অটোমোবাইল) ভারতে ফর্মুলা-ওয়ান করাচ্ছে, ঘটনা হল, রবিবার দুপুরে ভারতীয় খেলাধুলোয় গ্লাসনস্ত আসছে।
এফ ওয়ানের কেসটা ঠিক কী, নয়ডার বিআইসি-তে দিন দশেক আগে ফর্মুলা-ওয়ানের ট্র্যাকের লঞ্চে হাজির না থাকলে মাথায় ঢুকত না। এক্কেবারে পেটরোগা পাতি বাঙালি, ক্রিকেট নিয়ে অল্পস্বল্প লেখালেখির সুবাদে ক্রিকেট ট্যুর থেকে ফিরলে সান্ধ্য আড্ডায় বা ক্লাবে লোকে হুইস্কির গ্লাস হাতে জিজ্ঞেস করে, “সচিনের একশো নম্বরটা পেতে এত দেরি হচ্ছে কেন?” বা “জাহির খানের রিপ্লেসমেন্ট কেন পাওয়া যাচ্ছে না বলুন তো?” গম্ভীর মুখে বিশেষজ্ঞের মতামত দিয়ে ওই যে বুকের ছাতি এক সেন্টিমিটার ফুলে ওঠে, সেটার গোড়া ধরেই ঝাঁকিয়ে দিল ৭৫০ একরের বুদ্ধ ইন্টারন্যাশনাল সার্কিট। ১৭০টা দেশে ৫৮০ কোটি লোক টিভিতে রেসটা সরাসরি দেখবে। ৮০ কোটি? নাহ, চোখ কপালে তোলার কিছু হয়নি। গতির দুনিয়ার শেষ কথা, ড্রাইভিং স্কিলের শেষ কথা। কোত্থাও অতিশয়োক্তি নেই। ৫.১৪ কিলোমিটার বিস্তৃত ট্র্যাক দেখলে লালমোহনবাবু নির্ঘাত বলে ফেলতেন, “করেছেন কী মশাই!” সত্যি কথা বলতে কী, খেলাটা বোঝাও খুব বেশি কঠিন নয়। অত্যাধুনিক রেসিং ট্র্যাক, তাতে রেড বুল, ফেরারি, ম্যাকলারেন ইত্যাদি টিমের গাড়ি ছুটবে। প্রতি টিমের দুটো ড্রাইভার, যেমন হিসপানিয়া টিমের হয়ে স্টিয়ারিংয়ের পিছনে থাকবেন আমাদের নারায়ণ কার্তিকেয়ন। আর বাকিরা? বিশ্বসেরা গতির জাদুকররা প্রায় সবাই থাকছেন নয়ডায়। যেমন এখনকার বিশ্বসেরা এবং এক নম্বর রেড বুল রেসিং-এর সেবাস্তিয়ান ভেটেল, ম্যাকলারেনের জেনসন বাটন বা এফ-ওয়ান সার্কিটে সর্বকালের সেরাদের অন্যতম মাইকেল শু্যমাখার। মোট ৬০টা ল্যাপ, অতিক্রম করতে হবে মোট ৩০৮ কিলোমিটার। কখনও ধু ধু সমতল, কখনও বিপজ্জনক বাঁক বা চড়াই। থাকবে ১.২ কিলোমিটারের একটা লম্বা স্ট্রেচ, যেখানে গাড়ি ছুটবে ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার বেগে। যেখানে ট্র্যাক ইচ্ছাকৃত ভাবে চওড়া করা হয়েছে, যাতে ড্রাইভারদের ওভারটেক করতে সুবিধে হয়।
আর বিপদ? যে কোনও মুহূর্তে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা আর সে জন্য তৈরি বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেডিকেল টিম। মারণ কোনও পরিস্থিতি সামলাতে থাকছে দুটো হেলিকপ্টারও। মার্সিডিজ বেঞ্জ এসকর্ট কারে এক চক্কর মেরে এসে কার্তিকেয়ন স্বয়ং এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, “বিশ্বের প্রথম পাঁচটা সেরা ট্র্যাকের মধ্যে বিআইসি থাকবে। কোনও কথা হবে না।”
আর বিনোদন? আইপিএলের চিয়ারগার্লস এবং নৈশজীবনকে গুনে গুনে দশ গোল দেবে এফ-ওয়ানের গ্রিড গার্লস এবং নৈশজীবন। রিয়ালিটি শো-র মাধ্যমে গ্রিড গার্লস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে দেশের সেরা ৪৮ জন সুন্দরীকে। যারা ড্রাইভারদের ট্র্যাকে তো নিয়ে যাবেনই, রেস শেষে পুরস্কার বিতরণীতে শ্যাম্পেনের বোতলও খুলবেন। বাছাই করারা থাকবেন প্যাডক ক্লাব মানে ভিআইপি এনক্লোজারে। আর রাতের আফটার রেস পার্টি? সব ক’টার দায়িত্বে অর্জুন রামপলের ক্লাব ‘ল্যাপ’, সহযোগিতায় জেপি গ্রুপ।
কিন্তু এ সব নয়, আসল তো হল রেস। আর সেটা দেখতেই তো দিল্লি থেকে দু’ঘণ্টা জার্নি করে নয়ডায় আসা। প্রস্তুতি দেখেই তো চক্ষু চড়কগাছ! স্টেডিয়ামের ভিআইপি গ্যালারিতে বসার আগেই হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল একটা ইয়ার প্লাগ। রেস দেখতে ওই পুঁচকে যন্ত্রটা কেন অনিবার্য, মালুম হল মিনিট পাঁচেক পরেই। যখন রঙিন যন্ত্রদানব শুরু করল তার অসামান্য দৌড়। অঁ...অঁ...গঁ... সে কী আওয়াজ! শব্দ দিয়ে তা বোঝানোর চেষ্টা করার কোনও মানে হয় না। চলমান রঙিন বিদ্যুৎ অস্বাভাবিক শব্দ করে ছুটে চলে, হঠাৎ দাঁড়ায়, আবার পাক খায়, ছোটে। হঠাৎ ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুইস ড্রাইভার নীল জানি এক জায়গায় গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দেন। তারপর ভয়ঙ্কর স্পিডে একই জায়গায় চরকি পাক। ট্র্যাক থেকে আগুন বেরোয়। ধোঁয়া ওঠে। স্তব্ধ হয়ে সিটে বসে থাকে পেটরোগা বাঙালি, দু’চোখে লেগে থাকে একরাশ মুগ্ধতা। তার স্বপ্নের চাকা ঘোরে বনবন করে, ছন্দে ছন্দে তার রং বদলে বদলে যায়। জীবন-মৃত্যুর হাইওয়ে ধরে উল্কাবেগে ছুটতে থাকে গাড়ি।
প্রেস মিট সেরে গ্রেটার নয়ডার যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ফের দিল্লিমুখী। পিছনে বিআইসি-র বিশাল হোর্ডিং। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সেবাস্তিয়ান ভেটেলের কাটআউট। আলো পড়ে আসছে। পেটরোগা বাঙালি সামান্য বিষণ্ণ হয়। গুনগুন করে ওঠে, “ভাগ্যের চাকাটা তো ঘুরছে...ভাগ্যের চাকাটা তো ঘুরবেই...।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.