আর্থিক সঙ্কটে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এ বার রাজ্যের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নামলেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। আজ দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। দু’টি বৈঠক শেষে নারায়ণন বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, রাজ্যকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার প্রক্রিয়াটি তাঁরা ত্বরান্বিত করবেন।”
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কেন্দ্রের কাছে বিশেষ আর্থিক সাহায্যের জন্য দরবার করে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রতি জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকের সময় দিল্লি এসে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। অন্য রাজ্যগুলি থেকে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি কেন আলাদা এবং কেন তাঁর বিশেষ প্যাকেজ প্রয়োজন, সেটাও তিনি সেই বৈঠকে ব্যাখ্যা করেন। পর দিন জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকেও তিনি বলেন, বর্তমান সঙ্কটের অন্যতম বড়
|
এম কে নারায়ণন |
কারণ রাজ্যে ৩৪ বছর ধরে চলা ‘অপদার্থ’ বাম শাসন। তখনই রাজ্যের মাথায় ঋণের বোঝা চেপেছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে আশ্বাস দিলেও অন্য রাজ্যগুলিকে না চটিয়ে কোন পথে পশ্চিমবঙ্গকে সাহায্য করা হবে, তা নিয়ে এখনও সংশয়ে কেন্দ্র। বরং দিল্লি মমতাকে বলেছে, আপনি কর বাড়ান। জলকর বসান। মুখ্যমন্ত্রী তাতে নারাজ। তিনি উল্টে বলেছেন, কেন্দ্রের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদে ৩ থেকে ৫ মাসের জন্যে ছাড় দিন আমাদের। তাতেও আমাদের সুবিধা হবে। একই সঙ্গে দিল্লিকে তিনি জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার কোন পথে রাজস্ব বাড়াবে, তার রূপরেখা থাকবে আগামী বাজেটে।
এই পরিস্থিতিতে আজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দুই শীর্ষ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করলেন নারায়ণন। আগামিকাল থেকে যে দু’দিনের রাজ্যপাল সম্মেলন শুরু হচ্ছে, তাতে যোগ দিতে এখানে এসেছেন তিনি। এবং এসে ব্যাট ধরলেন রাজ্য সরকারের পক্ষে। রাজ্যপালের ঘনিষ্ঠমহল সূত্রে বলা হচ্ছে, নারায়ণন এটা মমতার জন্য করছেন এমন ব্যাখ্যা দেওয়াটা ঠিক নয়। রাজ্যপালের কাজ রাজ্যের পক্ষ নেওয়া। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই তিনি ‘সক্রিয়’ হয়েই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে।
রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট নিয়ে যখন সংখ্যাতত্ত্বের যুদ্ধ শুরু হয়েছে বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের মধ্যে, তখন কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে রাজ্যপালের এই মধ্যস্থতা তাৎপর্যপূর্ণ। নারায়ণন অবশ্য এই তরজা থেকে দূরত্ব রেখে রাজ্যের আর্থিক হাল ব্যাখ্যা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও প্রণববাবুর কাছে। তাঁর মতে, কার জন্য সঙ্কট, সেই নিয়ে চাপানউতোরের থেকে বেশি প্রয়োজন, সঙ্কটমোচনের রাস্তা খুঁজে বের করা।
পশ্চিমবঙ্গে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিধানসভা অধিবেশনের শুরুতে রাজ্যপালের বক্তৃতাতেও রাজ্যের আর্থিক সঙ্কটের বিষয়টি ছিল। রাজ্যের মোট ঋণের পরিমাণ যে ২ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, ওই বক্তৃতাতেই তার পূর্বাভাস দেন তিনি। গত আর্থিক বছরে বাম-সরকারের হিসেবে রাজস্বের সম্ভাব্য পরিমাণ যে অনেক বাড়িয়ে এবং খরচের পরিমাণ অনেক কমিয়ে বলা হয়েছিল, তা-ও জানিয়েছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীও যুক্তি দিয়েছেন, রাজ্যের মোট আয়ের অধিকাংশই যোজনা বহির্ভূত খাতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে (অমিতবাবুর সাম্প্রতিক বক্তব্য অনুযায়ী ১ টাকায় ৯৪ পয়সা)। উন্নয়নের জন্য কিছুই হাতে থাকছে না (১ টাকায় মাত্র ৬ পয়সা)। যোজনা বহির্ভূত খাতে ব্যয় মেটাতে তাই নগদ টাকার জোগান ও অনুদানের সমন্বয়ে একটি বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ চাইছেন মমতা। আজ রাজ্যপাল সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের কাছ থেকে এক রকম প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছেন। রাজ্যের আর্থিক হাল নিয়ে কেন্দ্রের কাছে দাবিদাওয়া জানানোর কাজে মধ্যস্থ হচ্ছেন রাজ্যপাল এমন ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। পশ্চিমবঙ্গে তো নয়ই। বাম জমানায় বীরেন শাহ বা নুরুল হাসানের সঙ্গে সুসম্পর্কই ছিল শাসক গোষ্ঠীর। এঁরা রাজ্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কেন্দ্রের কাছে বলেওছেন। কিন্তু এ ভাবে মধ্যস্থতাকারী হওয়ার ঘটনা বিরল বলেই মনে করছেন দিল্লির ওয়াকিবহাল মহল। রাজ্যপালের ঘনিষ্ঠমহল কিন্তু বলছে, রাজ্যপাল তো এক অর্থে রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যস্থই। আর এ কাজে তিনি নিজের এক্তিয়ার ছাপিয়েও যাননি। কারণ, সরকারের পক্ষ নিয়ে এই কাজ তিনি করতেই পারেন। আগামিকালের সম্মেলনেও নারায়ণনের রিপোর্টে রাজ্যের আর্থিক সমস্যার কথা থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। দেশের সার্বিক আর্থিক পরিস্থিতি ও রাজ্যগুলির আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে আজ সন্ধ্যায় অর্থমন্ত্রী সব রাজ্যপালের সঙ্গে একটি বৈঠকও করেন। একই সঙ্গে কালকের সম্মেলনে আলোচনা হবে মাওবাদী সমস্যার বিষয়টি নিয়েও। রাষ্ট্রপতি ভবনের তরফে আজ জানানো হয়েছে, এ বারের রাজ্যপাল সম্মেলনে মাওবাদী সমস্যার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে। পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী সমস্যার বর্তমান পরিস্থিতি এবং তাদের আলোচনায় বসানোর প্রয়াস নিয়েও কেন্দ্রকে রিপোর্ট দেবেন এম কে নারায়ণন। দার্জিলিঙের পরিস্থিতি সম্পর্কে রাজ্যপাল কী রিপোর্ট দিচ্ছেন, তা-ও জানার অপেক্ষায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সম্মেলনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমও উপস্থিত থাকবেন। তাঁর সঙ্গেও রাজ্যপালের আলোচনা হবে। |