|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
মাধ্যমটি এড়িয়েই গেলেন রবীন্দ্রনাথ |
সত্যজিৎ চৌধুরী |
রূপের কল্পনির্ঝর/সিনেমা আধুনিকতা রবীন্দ্রনাথ, সোমেশ্বর ভৌমিক। আনন্দ, ২৫০.০০ |
ক্ষোভ তো হয়ই। সাহিত্য এবং কলাবিদ্যার সব আঙ্গিকেই কিছু না কিছু কাজ করলেন, এমনকি নাচেও, কিন্তু তাঁর জীবনকালের সবচেয়ে শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথ তেমন মন দিলেন না। আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ (১৯২৫) আর ‘জেনারেল লাইন’ (১৯৩০) অংশত হলেও রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন। কিন্তু ভালমন্দ কোনও মন্তব্য করেননি। ইউরোপে কিন্তু ১৯৩০-এর মধ্যেই শিল্পী-সাহিত্যিক, মনস্বী-দার্শনিক সকলেই প্রযুক্তি-নির্ভর এই নতুন শিল্প-মাধ্যমটির অপার সম্ভাবনা নিয়ে গুরুত্বময় আলোচনা করেছেন।
সেই সময় আমরা কী করছিলাম? চলন্ত ছায়াছবি দেখানো এক বিশ্বজোড়া ব্যবসায় দাঁড়িয়ে গেল খুব দ্রুত। ভারতে পার্সি ব্যবসায়ীরা ব্যবসাটা ধরে নিলেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে ফিল্ম প্রদর্শন ব্যবসার এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলল ম্যাডান কোম্পানি। এই পুঁজি ছবি তৈরির কাজে খাটানো পরের ধাপ। কলকাতাতেও ফিল্ম প্রযোজনায় ম্যাডানদেরই অগ্রণী ভূমিকা।
ছবি করতে আখ্যান চাই। এই চাহিদাতেই চলচ্চিত্র জড়িয়ে যায় সাহিত্যের সঙ্গে, নাটকের সঙ্গে। ম্যাডান কোম্পানি কাজ শুরু করে ১৯১৯-এ গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘বিল্বমঙ্গল’ নিয়ে। ১৯২২-এ হল ‘বিষবৃক্ষ’, পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়। ম্যাডানদের অনুসরণে আরও বিনিয়োগ এল। থিয়েটারের মানুষরা এলেন, যেমন শিশির ভাদুড়ী, নরেশচন্দ্র মিত্র। ১৯২৩-এ তাঁরা রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে করলেন ‘মানভঞ্জন’। আমাদের নির্বাক সিনেমার সেই আদি পর্বেই দেশি প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন আখ্যানের প্রয়োজনে। শিশির ভাদুড়ী তাঁর থিয়েটারের শিল্পীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারক’ তুললেন ফিল্মে, সেন্সর বলল এ অতি নিম্ন রুচির কাজ, ছাড়পত্রই মিলল না। অনেক কাটছাঁট করে ‘বিচারক’ মুক্তি পায় ১৯৩২-এ। প্রযোজক সংস্থা বিপর্যস্ত। সেন্সরের কর্তা ছিলেন কুখ্যাত সেই পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট। এমন সব অজানা খবরে সোমেশ্বরের বইটি ভরা। দীর্ঘ দিনের খাটুনির চিহ্ন সর্বত্র। অবশ্যই আছে কয়েকটি মূল আগ্রহ, যার কেন্দ্রে আছেন রবীন্দ্রনাথ। আছে তত্ত্বজিজ্ঞাসা এবং ইতিহাসবিদ্যার আধুনিক পদ্ধতিতে তুচ্ছ খবরও একটা ফ্রেমে সাজানোর নিষ্ঠা। সোমেশ্বর বইটিকে কোনও প্রামাণিক ইতিহাস বলে দাবি করেননি। কোনও ঠাস বুনোট ইতিহাস দাঁড় করানোর মতো নথিপত্র তো পাওয়া যায়ই না আমাদের সিনেমার প্রথম তিন-চার দশকের। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সিনেমার যোগাযোগ নিয়ে তথ্যও সামান্যই, বইটির আয়তন তবু তিনশো পাতা ছাড়িয়ে গেছে। শুধু অনুমান আর কাল্পনিকতা দিয়ে এতটা বিস্তার ভরাট করা হয়েছে এমন নয়। আধুনিক এই শিল্পমাধ্যমটি ঘিরে সেই গড়ে ওঠার পর্বে কত যে সমস্যা! গল্প বাছাই, অভিনয়ের বিশিষ্ট শৈলী অনুশীলন, দৃশ্য পরম্পরার ভিতরে যুক্তির ধার অব্যর্থ করে তোলার বিচক্ষণতা বজায় রেখে দৃশ্যগুলি তোলা এবং কেটে-জুড়ে গোটা ব্যাপারটিকে সুস্পষ্ট বোধগম্য করে তোলা, এত দিকে নজর রেখে কাজ করতে গিয়ে সে যুগের পরিচালকেরা বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছেন। সোমেশ্বর সেই হারিয়ে যাওয়া অভিজ্ঞতার জগৎটি নির্মাণ করে ধরে দিতে চেয়েছেন এ কালের ফিল্ম-জিজ্ঞাসুদের সামনে। দেশি অভিজ্ঞতার বয়ান তৈরি করতে গিয়ে সমকালীন বিদেশি ফিল্ম-জগতের নানা প্রসঙ্গ খুব সঙ্গত ভাবেই এসে গেছে। ছিন্ন সুতো জুড়ে তুলতে রেখেছেন সু-বিস্তৃত ‘নির্দেশিকা’ যা শুধু দরকারি খবর দিচ্ছে না, প্রমাণ করছে লেখকেরও জিজ্ঞাসু মনের বিস্তার।
কবির জয়ন্তী-যাপনের গরজে নয়, চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখির ছোট বৃত্তে সোমেশ্বর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কাজ চালিয়ে এসেছেন দীর্ঘদিন। তুচ্ছতম খবরও চয়ন করে এসেছেন কখনও একটা বড় কাজে লাগানো যদি যায় ভেবে। অজস্র সেই চয়িত তথ্য বা তথ্যের টুকরো এত দিনে কাজে লাগল এই বই নির্মাণে। লেখক মাঝে মাঝেই একে বলেছেন হেলাফেলার কাজ। কেননা, এ তো আকাদেমিক গবেষণা নিবন্ধ নয়, বরং এক রম্য আখ্যানপট রচে তোলা, যার মধ্যে এ কালের পাঠক সেই ফেলে আসা সময়টির আলোয় হাওয়ায় অনুভবের মধ্যে পাবেন কী করে, কত উদ্যমে, কত আয়াসে মানুষের সংস্কৃতির এক-একটা শাখা ধাপে ধাপে বিকশিত হয়, পরিপূর্ণ শিল্পকলার মহিমা পায়।
এই প্রসঙ্গেই সুজ্ঞাত হলেও সর্বদা স্মরণীয় চলচ্চিত্র নিয়ে মুরারি ভাদুড়ীকে লেখা (নভেম্বর, ১৯২৯) রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত চিঠিটির তাৎপর্য। চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে অত গূঢ় কথা এর আগে বা পরে খুব একটা কেউ বলেননি। সোমেশ্বরের বিবরণে চিঠিটি লেখার প্রসঙ্গ স্পষ্ট জানা যাচ্ছে। টেগার্টের মাতব্বরিতে রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে তৈরি শিশির ভাদুড়ীর ‘বিচারক’ প্রদর্শন আটকে গেল। রবীন্দ্রনাথ ও শিশিরকুমার দু’জনেরই সম্মানে আঘাত লাগল। এর পরেও ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘তপতী’ নাটক চিত্রায়ণের প্রস্তাব আনলেন। প্রাসঙ্গিক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ নবীন শিল্পরূপ ফিল্মের নন্দনভিত্তি অব্যর্থ ভাবে নির্দেশ করে দিলেন, যার মর্মার্থ: সঙ্কর শিল্প হয় না, সব শিল্পেই ‘আপন সৃষ্টিজগতে আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা লক্ষ্য’, ছায়াচিত্র পুরোপুরি সাহিত্য-নির্ভর হয়ে আছে বলেই তার কলারূপের অনন্যতা প্রকাশ পায়নি। ছায়াচিত্রের মূল উপকরণ ‘দৃশ্যের গতিপ্রবাহ’। প্রকৃত চলচ্চিত্রে ‘এই চলমান রূপের সৌন্দর্য বা মহিমা’ বাক্যের বা অন্য উপকরণের নির্ভরতা ছেড়ে একটি স্বতন্ত্র ‘রসসৃষ্টিরূপে উন্মেষিত হওয়া চাই, যেমন সুরের চলমান ধারায় সঙ্গীত বিনা বাক্যেই আপন মাহাত্ম্য’ লাভ করতে পারে। সব শিল্পেরই অনন্যতা নির্ভর করে তার নিজস্ব ‘প্রকাশের ভাষায়’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমকালীন বাংলা ফিল্মে তেমন চরিতার্থতা দেখেননি। অনুভব করেছিলেন এর কারণ উপযুক্ত সৃষ্টিকর্তার অভাব আর ফিল্ম গড়তে প্রয়োজন হয় বড় রকমের মূলধনের।
এমন সম্ভাবনা রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মাত্র একবারই এসেছিল বিরূপ পরিস্থিতিতে, যা ব্যর্থ হয়ে যায়। প্রসঙ্গটি সোমেশ্বর জমাট করে লিখেছেন ‘লিখন তোমার হেলায়’ (পৃ. ৬২-৭৬) পরিচ্ছেদে। জীবনে আর এক বারই তিনি ফিল্মের এলাকায় এসেছিলেন বিশ্বভারতীর জন্য টাকার প্রয়োজনে। নিউ থিয়েটার্সের বীরেন্দ্রনাথ সরকার ‘নটীর পূজা’ চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। এ জন্য বিশ্বভারতীর তহবিলে দশ হাজার টাকা দিলেন। ছবি হল কবির তত্ত্বাবধানে। এতে কোনও চিত্রনাট্য ছিল না, ‘নটীর পূজা’ ফিল্ম হল নাটকের ধারা অনুক্রম ধরে। প্রকৃত অর্থে এ ছবিতে চলচ্চিত্র-শিল্পের প্রকরণগত কোনও বাধ্যবাধকতাই মানা হয়নি। ‘নটীর পূজা’ ১৯৩২-এর মার্চ-এপ্রিল জুড়ে চিত্রা আর পূর্ণ থিয়েটার হলে দিন পনেরো বাণিজ্যিক ভাবে দেখানো হয়। লোকে নিল না, উঠে গেল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পর্ক চুকে গেল। ‘নবশক্তি’ পত্রিকা লিখেছিল, রবীন্দ্রনাথের ‘নটীর পূজা’ পাদপ্রদীপের আলোকে যে রূপ নিয়ে ফুটে উঠেছিল, ছবির পর্দায় তার একটুও এদিক ওদিক হয়নি। ‘নটীর পূজায় চিত্ররূপের এইটাই সবচেয়ে বড় গলদ।’ স্টেজের নাটক আর ফিল্মের চিত্রনাট্যে গঠন এই টকির যুগেও যে সম্পূর্ণ বিভিন্ন, সে কথা নতুন করে নির্দেশ করবার সময় বহুকাল উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এই দরকারি কথাটি যাঁদের জানা নেই, তাঁদের পক্ষে ফিল্ম নির্মাণের কাজে হস্তক্ষেপ করা অনধিকার চর্চারই নামান্তর। কঠিন, কিন্তু যথার্থ সমালোচনা। ১৯২৯-এ রবীন্দ্রনাথ মুরারি ভাদুড়ীকে লিখেছিলেন ছায়াচিত্রের কলারূপের বিশেষত্বের কথা। সুযোগ যখন এল, সেই ‘বিশেষত্বের’ ভাবনা আদৌ ভাবলেন না তিনি।
ক্ষোভ থেকেই যায়। সমকালীন এই শিল্পমাধ্যমটি রবীন্দ্রনাথ এড়িয়েই গেলেন। সিনেমায় কলার চেয়ে কারদানি বেশি এই ধারণাটা যেন বদ্ধমূল হয়ে রইল।
মেধা-সমুজ্জ্বল এই বইটি আমাদের চলচ্চিত্রচর্চায় নানা ভাবেই কাজে আসবে, বিশেষ করে আনুষঙ্গিক তথ্য সঞ্চয়নের গৌরবে। |
|
|
|
|
|