ধুতির পাড়ে কবিতা লিখিয়ে রানির উপহার ভাইকে
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির কর্ত্রী মহারানি জ্যোতির্ময়ী দেবী কোনও এক বছর ভাইফোঁটায় ভাই বহরমপুর কাশিমবাজার রাজবাড়ির কর্তা কমলারঞ্জন রায়কে স্নেহ-উপহার হিসেবে শান্তিপুরের ধুতি দিয়েছিলেন। সেই ধুতির পাড় জুড়ে ছিল দিদির লেখা স্বরচিত কবিতা
‘দিদির এই স্নেহ-উপহার
আদরে পড়িবে ভাই
কমল আমার।’

দূর থেকে দেখলে তা কালো পাড় বলে মনে হলেও পাড় জুড়ে ছিল ওই কবিতার লাইন।
কাশিমবাজার রাজবাড়ির উত্তরপুরুষ প্রশান্তকুমার রায় বলেন, “পিসিমা কবিতা লিখতেন। তাই ভাইফোঁটায় তাঁর চেয়ে সাত বছরের ছোট ভাইকে ভাইফোঁটায় উপহার দেওয়ার জন্য শান্তিপুর থেকে ধুতি করিয়ে তাতে ভাইয়ের নাম এবং কবিতা লিখে তা কারিগরকে দিয়ে ধুতির পাড়ে খোদাই করিয়েছিলেন।” কমলারঞ্জনের দিদি জ্যোতির্ময়ী দেবীর সঙ্গে কৃষ্ণনগরের মহারাজ ক্ষৌণীষচন্দ্র রায়ের বিয়ে হয়। প্রশান্তবাবু বলেন, “ভাইফোঁটায় পিসিমা ঘূর্ণির তৈরি মাটির কাজে বিয়ে বাড়ি থেকে মুদি খানা, কালীপুজো থেকে সরস্বতী পুজো এবং সংকীর্তনের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হত। যা এখনও আমাদের বাড়িতে রয়ে গিয়েছে।”
কাশিমবাজার ছোট রাজবাড়িতে ভাইফোঁটা উপলক্ষে হরেক রকমের মিষ্টি বানানো হত। সরভাজা, সরপুরিয়া, চমচম, ক্ষীরের নাড়ু, ক্ষীরের ছাঁচ, রসমালাই, মোহনপুরি, মোতিপাক, ছানাবড়া, চন্দ্রপুলি-সহ আরও নানা মিষ্টি বানানোর জন্য ১০-১২ জন ময়রা সারা দিন ধরে রাজবাড়িতেই পড়ে থাকতেন। রাজবাড়ির পুত্রবধূ সুপ্রিয়া রায় বলেন, “সেই সময়ে চন্দ্রপুলি তৈরি করতে হত দু-হাতে কলা পাতা নিয়ে নারকেল-ক্ষীর-মোয়া দিয়ে মণ্ড তৈরি করে। তারপরে পুলির আকার দেওয়া হত।” এছাড়াও সারা দিন ধরে উনুনে বড় কড়াইতে বিভিন্ন ধরণের মিষ্টির ভিয়েন পাকত।
সুপ্রিয়াদেবী বলেন, “ভাইফোঁটার দুপুরে কিসমিস-কাজু দিয়ে গোবিন্দ ভোগের চালের মিষ্টি পোলাও তৈরি হত। থাকত ৭ রকম ভাজাআলু-পটোল, কাঁচকলা, বেগুন, শাক, নারকোল, কুমড়ো। বাড়িতে মাংসের খুব একটা চল হত না। পুজোর সময়ে পশুবলি হলে তখন মাংস হত। এছাড়াও পুকুরের বড় মাছ ধরা হত। মাছের বিভিন্ন রকম পদ রান্না ছাড়াও মাছের একটা স্পেশাল পদ রান্না হত, তার নাম ছিল মাছের চচ্চড়ি।” শাশুড়ি রানি হেনারানি ওই চচ্চড়ি নিজে হাতে রান্না করতেন। ভাইফোঁটার প্রতিটি রান্না পরাতে করে সাজিয়ে ভোগ হিসেবে পারিবারিক বিগ্রহ রাধা-গোবিন্দের সামনে নিবেদন করা হয়। ঠাকুরকে নিবেদন করার পরেই তা পরিবারের সদস্যরা এক সঙ্গে খেতে বসতেন।
দেবী সিংহের নসিপুর রাজবাড়িতে আবার ৭০-৮০টি গরু ছিল। ফলে ঘরের দুধ থেকেই ছানা তৈরি করে মিষ্টি তৈরির কাজে লাগানো হত। দেবী সিংহের বংশের ওই রাজবাড়ির বর্তমান বংশধর সৌরেন্দ্রনারায়ণ সিংহ বলেন, “ভাইফোঁটা উপলক্ষে বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি তৈরি হত বাড়িতেই। রাজভোগ, ক্ষীরমোহন, বোঁদে, ছানার পায়েস তৈরির পাশাপাশি ভাইঁফোটার দিন মিষ্টি পোলাও, লুচি, সাত রকম ভাজা থাকত দুপুরের মেনুতে।”
ভাইফোঁটা উপলক্ষে যে মিষ্টি তৈরি হত, তা বিভিন্ন রাজবাড়িতে উপহার হিসেবে পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। মিষ্টি পাঠানো হত কুঞ্জঘাটার রাজবাড়ি, জিয়াগঞ্জের রাজবাড়ি, নাটোরের রাজবাড়িতে। এমনকী কলকাতার পাথুরেঘাটা রাজবাড়িতে মিষ্টি যেত। এছাড়াও ভাইঁফোঁটার দিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মজলিস বসত। সেখানে গান-বাজনা হত। নসিপুর রাজবাড়িতে মজলিস বসত। ওই মজলিসে কলকাতার স্টার ও মিনার্ভা থিয়েটারের নিয়মিত শিল্পীদের মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক দিয়ে নিয়ে আসা হত রাজবাড়িতে। সৌরেন্দ্রনারায়ণবাবু বলেন, “ভাইফোঁটায় পিসিমাদের উপহার হিসেবে সোনার অলঙ্কার দেওয়া হত। পিসিমারাও আগে থেকেই তাঁদের পছন্দের গয়নার কথা বলে দিতেন।” অন্য দিকে জিয়াগঞ্জের রাজবাড়িতে ভাইফোঁটার তুলনায় বিজয়াদশী উপলক্ষে বেশি ধুমধাম হত। সুরেন্দ্রনারায়ণ সিংহের নাতি অজিত নারায়ণ সিংহ বলেন, “প্রফুল্ল সেনের আমলে কংগ্রেসের বিধায়ক ছিলেন বাবা কালীনারায়ণ সিংহ। আর বাবা-কাকারা ছিলেন ৫ জন আর আমাদের পিসিমা ছিল এক জন। পিসিমা রাজলক্ষ্মীদেবীর বিয়ে হয়েছিল ঝাঁসিতে। ফলে ভাইভোঁটার সময়ে আসতে পারতেন না। তবে বিজয়া দশমীকে ঘিরে বাড়িতে মজলিশ বসত। দারুণ সব খাওয়া-দাওয়া হত।” নসিপুর রাজবাড়ির উত্তপুরুষের অবশ্য স্বগতোক্তি“এত দিন পরে মনকে কেন ওই অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন? সব ভুলে বেশ তো ভাল আছি!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.