ব্যাগ গুছিয়ে...
রিং টোনে প্রকৃতির সুর
ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে লেহ্ প্যালেস। প্যালেসের মাথায় রাতের আকাশে অজস্র নক্ষত্রের প্রদর্শনী। দেখে মনে হয়, কেউ যেন খোদাই করে রেখেছে। রাতের এমন মায়াবী পরিবেশ উপলব্ধি করতে হলে আসতেই হবে লেহ্ ও লাদাখ। সিন্ধু নদের জলে পা ডুবিয়ে, বরফ ঢাকা পাহাড়ের কোলে সূর্যাস্ত দেখলে মনে হবে, কয়েক শতাব্দী আগের কোনও ঘটনা প্রত্যক্ষ করছেন।
লাদাখের কাছে পৌঁছনো মানেই পাহাড় আর মেঘের খেলা শুরু। বিমানের জানলা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ে বরফ ঢাকা সারি সারি পাহাড়। রহস্যে ঘেরা নির্জন ওই পাহাড় চূড়াগুলি অতিক্রম করে হঠাৎ ছবির মতো সাজানো ছোট্ট লেহ্ বিমানবন্দরে পৌঁছে যায় বিমান। বিমান থেকে নামার পরেই বোঝা যায় শীত আঁকড়ে ধরতে চাইছে। তাই বিমানে ওঠার সময়েই জ্যাকেট বা সোয়েটার রাখা ভাল। আর যদি লেহ্-মানালি হাইওয়ে বা লেহ্-শ্রীনগর হাইওয়ে দিয়ে আসেন তা হলে তো রাস্তাতেই লেহ্-র সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে।
লেহ্ শহরে মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল। দুর্বল ইন্টারনেট সার্ভিসও। তবে দরকারই বা কী ও সবের। এখন মোবাইলের রিং টোনের বদলে লেহ্-র পাহাড়ে বৌদ্ধ মঠে ঘণ্টাধ্বনি শোনার সময়।
ছোট-বড় বিভিন্ন রকমের হোটেল রয়েছে লেহ্ শহরে। আছে গেস্ট হাউসও। হোটেলের জানলা দিয়ে পাহাড় দেখা যাবে কি না তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। কারণ, আপনি রয়েছেন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে দশ হাজার ফুট উচ্চতায় পাহাড়ে ঘেরা এক উপত্যকায়।
তবে, প্রথম দিন এতটা উচ্চতায় পৌঁছে আপনার কিছু শারীরিক সমস্যা হতে পারে। যেমন, সামান্য শ্বাসকষ্ট, মাথা ধরা ইত্যাদি। লাদাখে এসে জিপে না ঘুরে যদি অ্যাডভেঞ্চার করার ইচ্ছা হয় তা হলে মোটরবাইক বা সাইকেল ভাড়া নিতে পারেন। হাঁটতে হাঁটতে চলে যান শহরের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা গ্রামগুলিতে। গ্রামবাসীদের সঙ্গে ভাব জমালেই বুঝতে পারবেন তাঁদের আতিথেয়তা।
কোনও ভ্রমণ গাইডের সিলেবাস মেনে নয়, নিজের ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়ান লাদাখ উপত্যকায়। চলে যেতে পারেন প্যাঙ্গং লেক। যে লেক ইদানিং ‘থ্রি ইডিয়টস লেক’ নামে বিখ্যাত। আবার বিভিন্ন পাহাড়ের কোলে বৌদ্ধ মঠগুলিতেও ঘুরে আসতে পারেন। তবে যে মঠেই যান না কেন আপনাকে একবার যেতেই হবে হেমিস মনাস্ট্রিতে। এই মঠে যাওয়ার পথটাই আপনাকে লাদাখের প্রেমে পড়ানোর জন্য যথেষ্ট। রাস্তায় সিন্ধু নদ পেরনোর সময়ে নেমে পড়ুন ছোট্ট সেতুতে। একের পর এক গমখেত পেরিয়ে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ গিয়েছে পাহাড়ের উপর হেমিস মনাস্ট্রিতে। কাঠের তৈরি এই মনাস্ট্রির ভিতরে ঢুকলে দেখতে পাবেন বুদ্ধমূর্তি থেকে কালীর মূর্তি। এখানে এসে মিউজিয়ামটা দেখতে ভুলবেন না যেন!সিন্ধু নদের ধারে বসেই সূর্যাস্ত উপভোগ করুন। আবার খুব ভোরেই সূর্যের আলো উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। লেহ্ শহর থেকে প্যাঙ্গং লেক ঘণ্টা পাঁচেকের পথ। লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করা ছাড়াও যাঁরা পক্ষীপ্রেমী তাঁদের পক্ষে এই লেক যেন স্বর্গরাজ্য। লেকের জলের রং যেন কোনও শিল্পীর রঙিন ক্যানভাস। তবে লেক দেখার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই দেখুন ‘থ্রি ইডিয়টস’ খ্যাত দি ড্রুক হোয়াইট লোটাস স্কুলও। স্কুল চত্বরে ঢুকলেই বুঝতে পারবেন, আর পাঁচটা স্কুল ক্যাম্পাসের থেকে ওই স্কুল কতটা আলাদা। পড়াশোনার সঙ্গে প্রকৃতি ভালবাসার পাঠও দেওয়া হয় এখানে। খুদে লাদাখি পড়ুয়াদের দেখে আফশোস হবে, এই স্কুল থেকেই যদি ফের পড়াশোনা করা যেত!
উপত্যকায় ঘুরতে ঘুরতে আপনাকে বার বার হাতছানি দেবে পাহাড়। আর সেই হাতছানি উপেক্ষা করতে না পারলে আপনাকে যেতেই হবে ১৮ হাজার ৩৮০ ফুট উচ্চতার খারদুঙ্গায়। এখানে যেতে গেলে পারমিট বানাতে হয়। পরিচয়পত্র দেখালে লেহ্ শহর থেকেই পারমিট মেলে।
অক্টোবর থেকে মার্চ পুরো উপত্যকা জুড়ে বরফ আর বরফ। তবে মে মাসেও খরদুঙ্গায় এলে বরফ দেখতে পাবেন। বিশ্বের উচ্চতম গাড়ি যাওয়ার এই রাস্তা আপনাকে একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে দেবে। পাহাড় ভেঙে ভেঙে ওঠার সময় দেখবেন নীচে সবুজ উপত্যকা। দেখবেন, অনেক পর্যটক আবার সাইকেল চালিয়ে ওই খাড়াই পথ দিয়ে যাতায়াত করছেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই অবশ্য বিদেশি। এতটা উচ্চতায় ওঠার আগে ভাল করে শীতের জামাকাপড় পড়ে নিন। এপ্রিলেই যান অথবা অগস্টে, খরদুঙ্গার পাহাড়ের খাঁজে জমে থাকা বরফ আপনাকে স্বাগত জানাবে। ভাগ্য ভাল থাকলে দেখবেন ক্যান্টিনের রাস্তার সামনেই জমে রয়েছে বরফ। এতটা উচ্চতায় শ্বাসকষ্ট হলে সেনাবাহিনীর অক্সিজেন মাস্কও রয়েছে।
একটু সময় পেলে চলে যান লেহ্ থেকে মিনিট পনেরোর রাস্তা সাব্ব গ্রামে। সেখানে আপেল বাগান দেখে আসুন। বাড়ি ফেরার আগের দিন লেহ্ বাজারে মার্কেটিং করতে পারেন। তবে দোকানপাট রাত ৮টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। ফেরার আগে লাদাখের এক টুকরো উষ্ণতা নিয়েই যান না প্রিয়জনের জন্য!

কী ভাবে যাবেন
দিল্লি থেকে প্লেনে। অথবা সড়ক পথে মানালি হয়ে লেহ্।
শ্রীনগর থেকেও কার্গিল হয়ে লেহ্ আসা যায়।
কখন যাবেন
লাদাখ যাওয়ার সেরা সময় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর।
অক্টোবর থেকে মার্চ বেশির ভাগ হোটেল বন্ধ থাকে।
সঙ্গে রাখবেন
সচিত্র পরিচয়পত্র। উচ্চতাজনিত সমস্যার মোকাবিলায়
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধ।

ছবি: অর্কপ্রভ ঘোষ




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.