পাকিস্তানের কারণে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যদি নিজেকে বিপন্ন মনে করেন, তবে তিনি নিশ্চয়ই খানিক সান্ত্বনা পাইতে পারেন হামিদ কারজাইকে দেখিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক স্তরে যে তীব্র তাপপ্রবাহ ও তাহাতে ইসলামাবাদের যে দাপট, তাহাতে ভারত অপেক্ষা অনেক গুণ বেশি উদ্বিগ্ন আফগানিস্তান। সম্প্রতি আফগান প্রেসিডেন্ট কারজাই মন্তব্য করিয়াছেন, যদি কখনও পাকিস্তান-আমেরিকা যুদ্ধ ঘটে, তাহা হইলে তাঁহার দেশ অবশ্যই পাকিস্তানের পাশে থাকিবে। মন্তব্যটি এক দিক হইতে স্বাভাবিক, কারণ আফগানিস্তান ও পাকিস্তান নিকট প্রতিবেশী। অন্য দিক হইতে দেখিলে, কারজাই-এর মন্তব্য অস্বাভাবিকও। এত দিন জানা ছিল, পাক সামরিক দফতর যে ভাবে জঙ্গি ইসলামকে লালন পালন করিতেছে, সমস্যা দেখিলেই জঙ্গি নেটওয়ার্ককে বাঁচাইতে উঠিয়া-পড়িয়া লাগিতেছে, তাহাতে ওয়াশিংটন যেমন ক্ষুব্ধ, তেমনই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কাবুলও। গত কয়েক সপ্তাহে মার্কিন বিদেশ মন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টনের সহিত গলা মিলাইয়া আফগান প্রেসিডেন্ট কারজাই বার্তা দিয়াছেন, ইসলামাবাদকে শক্ত হইতে হইবে, জঙ্গিদের সহিত সামরিক উচ্চকর্তা ও সরকারি গোয়েন্দা দফতরের যে সকল যোগসাজশ তাহা বন্ধ করিতে হইবে। অকস্মাৎ কারজাই-এর পাকিস্তানের সহিত সহমর্মিতা জ্ঞাপন আশ্চর্য করিতে বাধ্য। এই ভোলবদলের অনেক ব্যাখ্যা সম্ভব। তবে একটি সত্য সব ব্যাখ্যার মধ্যেই উহ্য থাকিবে: কারজাই-এর বিপন্নতা। দুই যুযুধান পক্ষের মধ্যে তাঁহার অবস্থা সঙ্গিন বলিয়াই বিপন্ন কারজাই যখন যে পক্ষকে পারিতেছেন তুষ্ট করিয়া চলিতেছেন।
আমেরিকা ও পাকিস্তানের মধ্যে পারস্পরিক উষ্মা সম্প্রতি উচ্চগ্রামে উঠিয়াছে হাক্কানি শিবিরের বিষয়টি লইয়া। ওয়াশিংটন নানা তথ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করিয়া দাবি করিতেছে, যে হাক্কানি বহু আমেরিকা-বিরোধী অভিযানের মূল নায়ক, কাবুলে মার্কিন দূতাবাসের সামনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ-কাণ্ডের পিছনে প্রধান-মস্তিষ্ক, তাঁহার কিন্তু পাক সরকারি গোয়েন্দা দফতর আই এস আই-এর সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এমনকী এই নেটওয়ার্ক যে এক অর্থে আই এস আই-এর-ই অন্যতর বাহিনী, এমনও দাবি করা হইয়াছে ওয়াশিংটন হইতে। চিরাচরিত প্রথানুযায়ী, ইসলামাবাদের একাংশ ক্ষিপ্ত, অন্য অংশ নির্বিকার। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মুশারফ কিংবা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গিলানি কিংবা বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানির মতে আমেরিকা মুখ সামলাইবার চেষ্টা করুক, নতুবা পাকিস্তানের মিত্রতা তাহারা হারাইবে। অভিযুক্ত গোয়েন্দা দফতর কিংবা সামরিক দফতর সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। কিছুতেই যেন কিছু আসিয়া যায় না।
পাকিস্তানের একটি প্রতি-যুক্তি সঙ্গত যে, এই নেটওয়ার্কটিকে তো ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়ে আমেরিকাই দুধকলা দিয়া পুষিয়াছিল। সঙ্গত হইলেও এই যুক্তি কিন্তু কোনও ভাবেই পাকিস্তানের জঙ্গি-পোষণের গুরুত্ব কমাইতে পারে না। ভারতের সহিত ছায়াযুদ্ধের কারণে ১৯৪৭-পরবর্তী এক বিশাল সময়ে ইসলামাবাদ যে ভাবে এই জঙ্গিদের মাথায় তুলিয়াছে, তাহার পর অন্যদের প্রতি ইসলামাবাদের তর্জনী-নির্দেশ সাজে না। ও অধম বলিয়াই আমি অধম হইব, দরকারে আরও অনেক বেশি অধম হইব, ইহা কূটনীতি কেন, কোনও নীতিশাস্ত্রেরই দস্তুর নহে। সেই দিক হইতে, সাম্প্রতিক এই পাক-মার্কিন বাক্-সংঘর্ষ ভারতের পক্ষে একটি দুর্লভ সুযোগও বটে। যে কোনও প্রকারেই ইসলামাবাদের জঙ্গি-পোষণ নীতির বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের চাপ তৈরি হইলে ভারতের তাহাতে সাক্ষাৎ লাভ। |