তিনি সর্বজনীন ‘দিদি’। বছরে ৩৬৫ দিন। ‘লিপ-ইয়ারে’ ৩৬৬। কিন্তু এই এক দিন সেই ভূমিকা হাতে-কলমে প্রয়োগের সুযোগ আসে। তিনিও তা হাতছাড়া করেন না। এ বারও করেননি।
তফাত বলতে, ‘রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী’ হিসাবে এ বারই তাঁর প্রথম ভাইফোঁটা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রিত্বের ঘেরাটোপ আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কবে দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছে! কালীঘাটের ৩০বি, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে অতএব শুক্রবার সকাল থেকে বয়সে এবং কলেবরে বিভিন্ন সাইজের ভাইদের লাইন! রক্তের সম্পর্কের ভাইদের পাশাপাশি আহূত, রবাহূত এবং অনাহূতও। মুখ্যমন্ত্রীও ‘দিদি’সুলভ কায়দায় যত জনের পেরেছেন, কপালে আঙুল ছুঁইয়েছেন। তাঁর নিরাপত্তা বলয়ের কর্মীরা, রাজনীতিক, কর্তব্যরত সাংবাদিক সকলেই সামিল। লাইনে দাঁড়ানো নিতান্ত অপরিচিতও এ দিন বাঁধা পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর ‘ভ্রাতৃত্বে’র বন্ধনে। সঙ্গে মিষ্টিমুখ। কচিকাঁচা কিছু মুখ ‘দিদি’র ফোঁটা পেয়ে রীতিমতো অভিভূত! |
ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার পরব শুধু পরিবারের গণ্ডিতে না-রেখে বৃহত্তর আঙিনায় পালন মমতার অবশ্য বহু দিনের রেওয়াজ। যখন তিনি শুধুই তৃণমূল নেত্রী (এমনকী, যখন তাঁর রাজনীতির লেখচিত্র একেবারে তলানিতে), তখনও নিয়ম করে এই দিনটায় সুলতান আহমেদ, জাভেদ খান, ফিরহাদ হাকিম, ডেরেক ও’ব্রায়েনদের ফোঁটা দিয়েছেন (তখনও ফোঁটা দিতেন এআইসিসি সদস্য সমীর চক্রবর্তী, দলের নেতা মুকুল রায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়দের। এ বারও দিয়েছেন। তবে মাতৃবিয়োগের কালাশৌচ চলায় কল্যাণ ফোঁটা নিতে পারেননি। উপহার এবং দিদির খাবার নিয়েছেন শুধু)। ধর্ম-মত-সম্প্রদায়ের দেওয়াল সচেতন ভাবেই ভেঙেছেন। ব্যতিক্রম হয়েছিল গত বার। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মৃত্যুজনিত শোকের আবহে সেই ধারায় ছেদ পড়েছিল। অবশ্য মমতার দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, এঁরা সকলেই তাঁর ‘বৃহত্তর পরিবারের’ অংশ। তবু ‘মুখ্যমন্ত্রীর ভাইফোঁটা’ বলেই বাৎসরিক রীতি হয়েও এ বারের দিনটা অন্য রকম।
যেমন ‘অন্য রকম’ ছবি ধরা পড়ল উত্তর কলকাতার মিনার্ভা থিয়েটারের কাছে এক সংস্থার আয়োজিত ভাইফোঁটার আসরে। ‘মমতা-পন্থী’ নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ যেখানে ভাইফোঁটা দিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা প্রাক্তন সাংসদ মহম্মদ সেলিমকে। অর্পিতা যখন ওই আসরে গিয়ে পৌঁছন, তখন সেখানে গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা রজতাভ দত্তদের সঙ্গে উপস্থিত সেলিমও। এক যাত্রায় পৃথক ফল করার কোনও কারণ দেখেননি অর্পিতা। সম্প্রীতির এমন আসরকে রাজনীতির দৃষ্টি থেকে দেখার কথাও তাঁর মনে হয়নি। অর্পিতা বলেন, “আমার খুব ভাল লাগছে। পৃথিবীতে যে ভাবে হিংসা ছড়াচ্ছে, তাতে ভ্রাতৃত্ববোধের এই ধারণা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।” আর সেলিমের কথায়, “ভাইফোঁটার তাৎপর্যই এই রকম। সেখানে কোনও ভেদাভেদ থাকে না।” |
‘ভেদাভেদ’ রাখেননি রাজনীতির অন্য কারবারিরাও। কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় যেমন অতীন ঘোষ, শশী পাঁজা-সহ ‘সপারিষদ’ হাজির থেকেছেন যৌনকর্মীদের ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানে। পুরসভার তরফে যৌনকর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থাও চালু করেছেন এই উপলক্ষে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু গিয়েছেন স্টুডেন্টস হেলথ হোমে ফোঁটা নিতে। মমতার মতো বিমানবাবুরও এটি বাৎসরিক আচার। দলের জন্য ‘নিবেদিত’, আলিমুদ্দিনের বাসিন্দা বিমানবাবুর কথায়, “বাড়ি থেকে যখন চলে এসেছিলাম, বলে এসেছিলাম, তোমরা আমাকে বড় করেছো। তোমাদের কাছে আমি ঋণী। তার পর থেকে বাড়ির কোনও অনুষ্ঠানে আর অংশ নিইনি। প্রতি বার ভাইফোঁটায় আমি এখানে আসি। ভাইফোঁটার মাহাত্ম্য এখানেই অনুভব করতে পারি।”
‘ভেদাভেদ’ অতিক্রমের কথা বোঝাতে বিমানবাবু আরও বলেছেন, “আজই যেমন একটি মুসলিম মেয়ে আমায় ফোঁটা দিয়েছে। এর থেকেই প্রমাণিত ভাইফোঁটার প্রয়োজনীয়তা এবং মাহাত্ম্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় এটা একটা বড় অনুষ্ঠান। যত দিন বাঁচব, এখানে আসব!”
রাজ্য প্রশাসনের সর্বময় কর্ত্রী নিরাপত্তা এবং পদ-জনিত গাম্ভীর্যের গণ্ডি ভেঙে ভাইফোঁটা দিচ্ছেন। পরিবারের আরাম স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে-আসা রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের রাজ্য সম্পাদক যাচ্ছেন অপরিচিতের মাঝে ‘সম্প্রীতি’র বাঁধনে ধরা দিতে। মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরসূরির ‘ঘনিষ্ঠ’ নেতার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন ‘মমতাপন্থী’ বিশিষ্ট। ‘ভেদাভেদ’ই যখন মুছছে, ‘পরিবর্তনে’র বঙ্গে একটা ছবিই দেখা বাকি থাকল বঙ্গজনের ভাইফোঁটার ‘সম্প্রীতি’র আবহে তৃণমূল নেত্রীর বাড়ি গিয়ে শুভেচ্ছা-ফোঁটা নিচ্ছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক!
যম-দুয়ারে কাঁটা দিয়ে এত ‘সাহস’ কি হবে ‘পরিবর্তনে’র বাংলার?
|