মুম্বই সন্ত্রাসের পরে ভারতের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় জঙ্গিদের এমন কড়া সুরে ‘ভর্ৎসনা’ করেন যে পাক প্রশাসনের মনে হয়েছিল, ভারত হয়তো তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চলেছে।
২০০৮ সালের ‘চাঞ্চল্যকর’ এই তথ্য জানা গিয়েছে প্রাক্তন মার্কিন বিদেশসচিব কন্ডোলিজা রাইসের সাম্প্রতিক বই ‘নো হায়ার অনর’ থেকে।
২৬/১১-র পরবর্তী সময়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন, সেটা প্রাথমিক ভাবে বুঝতে পারেননি কন্ডোলিজাও। সাময়িক ভাবে তাই উদ্বেগে ছিলেন তিনি। কারণ হোয়াইট হাউসের এক প্রতিনিধি প্রাক্তন মার্কিন বিদেশসচিবকে জানান, ‘পাকিস্তানিরা বলছে ভারতীয়রা যুদ্ধ শুরু করার হুমকি দিয়েছে তাদের।’ এ সব শুনে চমকে যান রাইস। প্রণববাবুর সঙ্গে ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাননি রাইস।
‘নো হায়ার অনর’-এ তিনি লিখেছেন, পাকিস্তান থেকে উদ্ভূত এই ‘ভুল গুজবে’র জেরে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশও। পরিস্থিতি সামলাতে বুশ তড়িঘড়ি কন্ডোলিজাকে ইসলামাবাদ এবং দিল্লিতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। দ্বিধায় পড়ে যান কন্ডোলিজা। কারণ মুম্বই সন্ত্রাসের দিন দুয়েকের মধ্যে ভারতের তরফে তাঁকে জানানো হয়েছিল, ‘উত্তপ্ত পরিস্থিতি প্রশমিত করার উপরেই জোর দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে পাকিস্তানকে বোঝানো হচ্ছে, তারা মুম্বই সন্ত্রাসে জড়িত জঙ্গিদের দ্রুত শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করুক।’ |
অথচ গোটা বিশ্বে চাউর হয়ে গিয়েছে ভারতের হুমকির ‘গল্প’। পরিস্থিতি আঁচ করতে সরাসরি প্রণববাবুর সঙ্গেই কথা বলতে চেয়েছিলেন কন্ডোলিজা। এই সময়ে প্রণববাবুর সঙ্গে ফোনে কথা হয় তাঁর। সব শুনে অবাক হয়ে যান ভারতের সেই সময়কার বিদেশমন্ত্রীও। তিনি তখন দিল্লির বাইরে নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে ভোট নিয়ে ব্যস্ত। কন্ডোলিজা লিখছেন: প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, “এ সব কী? আমরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলে আমি কি দিল্লির বাইরে বসে থাকব?” এর পরে প্রণববাবু রাইসকে জানান তৎকালীন পাক বিদেশমন্ত্রী শাহ মহম্মদ কুরেশিকে তিনি বলেছিলেন, “ওরা (জঙ্গিরা) কিন্তু আমাদের জন্য যুদ্ধ ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা রাখছে না।” কুরেশি তাঁর ‘কড়া কথার’ ভুল ব্যাখ্যা করেছেন বলে দাবি করেন প্রণববাবু। গোটা বিষয় এ বার স্পষ্ট হয় রাইসের কাছে।
‘নো হায়ার অনর’ থেকে জানা যাচ্ছে, জরুরি সফরে নয়াদিল্লিতে যাওয়ার পরে রাইসকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং প্রণববাবু জানান, তাঁরা যুদ্ধের বিরোধী। তাঁরা চান, পাকিস্তান জঙ্গিদমনে সক্রিয় হোক।
এর পরে ইসলামাবাদে পৌঁছন কন্ডোলিজা। তাঁর মন্তব্য, সেখানে পাক নেতৃত্ব তখনও মানছেন না, তাদের দেশের জঙ্গিরা ভারতে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু রাইস পাক প্রধানমন্ত্রী গিলানিকে সাফ বলেন, “হয় আপনি মিথ্যে বলছেন। না-হলে আপনার প্রশাসনের লোকজন আপনাকে মিথ্যে বলছে। হামলার
পিছনে কারা আছে, সে ব্যাপারে আমেরিকাও কিছুটা জানে।” মুম্বই সন্ত্রাস নিয়ে ওই বইয়ের এক অধ্যায়ে রাইস লিখেছেন, “আমি পাক সরকারকে অভিযুক্ত করিনি। কিন্তু পাক সেনার মধ্যে কেউ জঙ্গিদের সাহায্য করতে পারে বলে মনে হয়েছিল আমাদের।”
২৬/১১ পরবর্তী সময়ে ভারতের তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়ণন পদত্যাগ করতে চেয়েছেন এই খবরও রাইসের কানে পৌঁছেছিল। নারায়ণনের সঙ্গে মুম্বই সন্ত্রাসের পরে দেখা করার কথাও বইয়ে লিখেছেন কন্ডোলিজা। তাঁর মতে, ৯/১১-র পরে আমি যে রকম আঘাত পেয়েছিলাম, নারায়ণনেরও একই অবস্থা হয়েছিল। কন্ডোলিজা এর পরে লিখছেন, “ওঁকে আশ্বস্ত করতে ওঁর হাত ধরে আমি বলি, এতে আপনার দোষ নেই।” নারায়ণন উত্তরে কী বলেছিলেন, সেটা অবশ্য মনে করতে পারেননি রাইস। |