তিন মাস আগে বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতালে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলে এসেছিলেন, জেলা থেকে রোগী রেফার করার প্রবণতা না কমালে সঠিক পরিষেবা দেওয়া যাবে না। কমানো যাবে না শিশুমৃত্যুর হারও। সেই বিষয়ে স্বাস্থ্য দফতরকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরিস্থিতি যে এক চুলও বদলায়নি, ৩৬ ঘণ্টায় ১০টি শিশুর মৃত্যুর পরে তা পরিষ্কার হয়ে গেল।
১০টি শিশুর মৃত্যুতে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে হাসপাতালে বিক্ষোভ দেখান রোগীর আত্মীয়দের কেউ কেউ। নারকেলডাঙা মেন রোড অবরোধও করা হয় এ দিন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, যে ১০ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে তার মধ্যে ছ’জনকেই রেফার করে পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে। বাকি চার জন অবশ্য বিসি রায়ের আউটডোর থেকেই ভর্তি হয়েছিল। অন্য হাসপাতাল থেকে যারা এসেছিল, সেই শিশুরা ভর্তিই হয়েছিল অত্যন্ত খারাপ অবস্থায়। অন্তত তিন জনের ক্ষেত্রে রোগীকে এই হাসপাতালে পাঠানোর কোনও যুক্তি খুঁজে পাননি চিকিৎসকেরা। রোগীর ‘কেস-হিস্ট্রি’ দেখে চিকিৎসকদের বক্তব্য, জেলা হাসপাতালে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা হলেই বরং রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু রেফারেলের ফলে অযথা কালক্ষেপ এবং ছোটাছুটিজনিত ধকলের জেরে তাদের অবস্থার আরও অবনতি হয়।
|
সন্তানহারা। বুধবার
বিসি রায় হাসপাতাল
চত্বরে। —নিজস্ব চিত্র |
এ দিনের পরিসংখ্যান কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। হাসপাতাল জানাচ্ছে, প্রতিদিন ওই হাসপাতালে গড়ে ৫০টির মতো শিশু ভর্তি হয়। তার অর্ধেকই আসে অন্য হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে। হাসপাতালের এক চিকিৎসকের দাবি, দৈনিক রেফার হওয়া গড়ে ২৫টি শিশুর মধ্যে বড়জোর ৭ থেকে ১০টিকে রেফার করার পিছনে যথাযথ যুক্তি থাকে। বাকি ক্ষেত্রে জেলা হাসপাতালগুলি দায় এড়ায়। এই ‘অপ্রয়োজনীয়’ রেফারেলের দৌলতেই বিসি রায় হাসপাতালের নাভিশ্বাস উঠেছে। এবং এই ‘অপ্রয়োজনীয়’ রেফারেল ব্যবস্থাই বন্ধ করতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই নির্দেশ মানা শুরু হয়নি তিন মাসেও। |
|
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ সব হাসপাতালেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জেলা হাসপাতালগুলি পরিকাঠামোর দোহাই দিয়ে রোগী পাঠিয়েই যাচ্ছে কলকাতায়। সব থেকে বেশি চাপ পড়ছে বিসি রায় শিশু হাসপাতালের উপরে। জেলা হাসপাতালগুলির দায়বদ্ধতা না বাড়লে আমাদের কিছু করার নেই।” হাসপাতালের অধ্যক্ষ মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই রয়েছি। এখনও জেলা থেকে অকারণে রেফার করা হচ্ছে এই হাসপাতালে। শহরের অন্য মেডিক্যাল কলেজগুলিও নিজেরা ভর্তি না করে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
আমরা কাউকে ফেরাচ্ছি না ঠিকই। কিন্তু রোগীর এই বিপুল স্রোত সামলাব কী ভাবে?”
হাসপাতালের ৩৬০টি শয্যায় সব সময়েই অন্তত ২০ থেকে ২৫টি অতিরিক্ত শিশু ভর্তি থাকে। ভিড় সামলাতে একই শয্যায় রাখতে হয় একাধিক শিশু। চিকিৎসকেরা নিজেরাই বলছেন, এটা চিকিৎসাবিধির পরিপন্থী। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কম। একই শয্যায় একাধিক রোগী থাকলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তার উপরে এখানে যারা ভর্তি থাকে, তাদের বেশির ভাগের অবস্থাই খারাপ থাকে। অনেক সময় এই কারণেই শিশুমৃত্যু হয় বলে চিকিৎসকদের একাংশের দাবি। স্বাস্থ্য কর্তা কিংবা হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ যা-ই বলুন না কেন, মৃত শিশুদের পরিবারের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তির পরে ঠিকঠাক চিকিৎসা তো হয়ইনি। উপরন্তু নার্সরাও ঠিকঠাক ওষুধপত্র বা ইঞ্জেকশন দেননি। হাসপাতালের অধ্যক্ষ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, সব ক’টি শিশুই মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছেছিল। তার পরেও তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তা-ও তাদের বাঁচানো যায়নি।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাতে কৈখালি এলাকার বাসিন্দা আট মাসের একটি শিশুকে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বুধবার সকাল সওয়া ৯টা নাগাদ তার মৃত্যু হয়। এর পরই চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তোলেন মৃতের পরিজনরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, শিশুটির প্রচণ্ড জ্বর ছিল। চিকিৎসকেরা তাকে খাওয়ানোর ব্যাপারে বাড়ির লোককে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু শিশুটির মা সে কথা না শুনে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময়েই শ্বাসরোধ হয়ে তার মৃত্যু হয়।
কিন্তু হাসপাতালের বক্তব্যে খুশি হতে পারেননি রোগীর বাড়ির লোকজন। ক্রমশ উত্তেজনা ছড়াতে থাকে। পুলিশ জানায়, সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ প্রায় শ’খানেক লোক নারকেলডাঙা মেন রোড অবরোধ করেন। প্রায় আধ ঘণ্টা ওই অবরোধ চলে। এই ঘটনার সূত্র ধরে মৃত অন্যান্য শিশুর পরিবারের লোকেরাও চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। তাঁদের অভিযোগ, চিকিৎসাকর্মীরা তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। এ নিয়ে হাসপাতালের সুপারের সঙ্গেও কথা বলেন তাঁরা। তবে লিখিত কোনও অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। |