ক্ষমতায় থাকার সময় বিরোধীদের কাছ থেকে যে অভিযোগ বারবার শুনেছে সিপিএম, এ বার ক্ষমতা হারিয়ে শরিক দলের কাছ থেকেই শুনতে হল সেই নালিশ!
বাম আমলে রাজনীতির রং দেখে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে সরব হল ফ্রন্ট শরিক সিপিআই। ক্ষমতায় এসেই যে ‘অনিলায়ন’ বন্ধ করতে অর্ডিন্যান্স জারি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে গণতন্ত্র হরণ করা হচ্ছে, এই অভিযোগে সেই অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে দলের ছাত্র সংগঠন এসএফআই-কে সঙ্গে নিয়ে ইতিমধ্যে আন্দোলনেও নেমে পড়েছে সিপিএম। এই পরিস্থিতিতে সিপিআইয়ের সমালোচনাকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলেই মনে করা হচ্ছে। যা সিপিএমের আন্দোলনের ধার দুর্বল করে দিতে পারে।
বুধবার সিপিএমের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে সিপিআই নেতারা প্রশ্ন তোলেন, দলের লোক না হলে উপাচার্য করা যাবে না, বামফ্রন্টের আমলে এর কি সত্যিই কোনও
দরকার ছিল? রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে নিজের পছন্দের লোক বসানোর ব্যবস্থা চালু করেছিলেন প্রাক্তন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। শিক্ষা ক্ষেত্রে যা ‘অনিলায়ন’ নামে পরিচিত। পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করতে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের সুরে সিপিআই-ও এ দিন সিপিএম নেতাদের শুনিয়ে দিয়েছে যে, দলের লোক না-হলে উপাচার্য করা করা যাবে না, শিক্ষাক্ষেত্রের এই ‘অনিলায়ন’ আখেরে শিক্ষা ব্যবস্থারই ক্ষতি করেছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য একদা সিপিআই-ঘনিষ্ঠ সন্তোষ ভট্টাচার্যের উদাহরণ তুলে ধরে সিপিআই নেতারা বলেন, সন্তোষবাবুর সঙ্গে যা ব্যবহার করা হয়েছিল, তার কি কোনও প্রয়োজন ছিল? সন্তোষবাবুর প্রতি বিরূপ আচরণ করে তাঁকে ‘শত্রু শিবিরে’ ঠেলে দেওয়ার কি সত্যিই কোনও দরকার ছিল? উল্লেখ্য, অবসরের পরে সন্তোষবাবু এক বার লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস সমর্থিত প্রার্থী হয়েছিলেন। সন্তোষবাবু উপাচার্য থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে দিনের পর দিন আন্দোলন করে বামপন্থী শিক্ষাকর্মী সংগঠন এবং এসএফআই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত অচল করে রেখেছিল।
এ দিন সিপিআই নেতাদের এই প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যিনি দলে ‘অনিলায়ন’-এর বিরোধী বলেই পরিচিত। কিন্তু অনিলবাবুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত করার চেষ্টায় তিনি সফল হননি। বুদ্ধবাবুর প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্সিকে স্বশাসন দেওয়ার বিষয়টি অনিলবাবুর আমলে আটকেই ছিল। এমনকী, অনিলবাবুর মৃত্যুর পরে প্রেসিডেন্সি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও আলিমুদ্দিনের নিয়ন্ত্রণ থেকে তাকে মুক্ত করতে পারেননি বুদ্ধবাবু। এ দিন সিপিআই নেতাদের সমালোচনার কোনও উত্তর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেননি। চুপ করে ছিলেন সিপিএমের বর্তমান রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও। পরে সিপিএম রাজ্য নেতৃত্বও বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। দলের এক রাজ্য নেতা বলেন, “যদি কিছু বলার থাকে তা হলে একমাত্র বিমানদাই বলবেন।”
বুদ্ধবাবু যা পারেননি, ক্ষমতায় এসেই তা করার দিকে মন দিয়েছেন মমতা। শিক্ষাক্ষেত্রকে রাজনীতি মুক্ত করার লক্ষ্যে জারি করা তাঁর অর্ডিন্যান্সে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালন সমিতিতে আর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থাকতে পারবেন না। উপাচার্যরাও যুক্ত হতে পারবেন না রাজনৈতিক কার্যকলাপে। উপাচার্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিচালন সমিতির বদলে তিন সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গড়া হবে। যাতে আচার্য এবং ইউজিসি-র প্রতিনিধি ছাড়া থাকবেন পঠনপাঠনের সঙ্গে যুক্ত অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি।
রাজ্যের এই উদ্যোগে শিক্ষাক্ষেত্রে সাড়ে তিন দশকের মৌরসীপাট্টা খোয়ানোর অশনি সঙ্কেত দেখছে সিপিএম। ফলে অর্ডিন্যান্স জারির পরেই সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে আন্দোলনে নেমে পড়েছে তারা। দলতন্ত্র ঘোচানোর নামে সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে গণতন্ত্র হরণ করছে, এই অভিযোগে এক দিকে যেমন রাস্তায় নেমেছে দলের ছাত্র সংগঠন এসএফআই, তেমনই প্রচার শুরু হয়েছে দলীয় মুখপত্রেও। কিন্তু এ দিন শরিক দলের সমালোচনা তাদের আন্দোলনকে ধাক্কা দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সিপিআইয়ের সমালোচনার কথা শুনে এ দিন এক তৃণমূল নেতার তীর্যক মন্তব্য, “ইতিহাসের এটাই পরিহাস! এত দিন আমরা যা বলতাম, সেটাই এ বার ওদের শরিকদের কাছ থেকে শুনতে হল।”
বুদ্ধবাবুর শিল্পনীতির সমালোচনা করে সিপিআই নেতারা বলেন, এত বেশি করে তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পের দিকে না ছুটে বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প পাট, চা ও কৃষি ভিত্তিক শিল্পের উপর বেশি জোর দেওয়া উচিত ছিল। তা হলে কৃষিরও উন্নতি হত, কর্মসংস্থানও বাড়ত। বুদ্ধবাবুকে তাঁরা প্রশ্ন করেন, পাট শিল্পের আধুনিকীকরণের উপরে কি বেশি জোর দেওয়া যেত না? সিপিআই নেতাদের মতে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পিছনে না ছুটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উপরে
বামফ্রন্টের বেশি জোর দেওয়া উচিত ছিল। বুদ্ধবাবুর সামনে তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, নন্দীগ্রামে জোর করে কেমিক্যাল হাব তৈরির চেষ্টা করার সত্যিই কি কোনও প্রয়োজন ছিল?
সিপিআই নেতারা আরও বলেন, খেতমজুররা সংখ্যায় বিপুল। কিন্তু তাদের জন্য সরকার সে ভাবে কিছু করেনি। সিপিআই নেতাদের প্রশ্ন, কেরল বা তামিলনাড়ু যদি খেতমজুরদের স্বার্থে আইন করতে পারে, তা হলে বামফ্রন্ট সরকার তা পারল না কেন? তাঁদের প্রশ্ন, গ্রামীণ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেরও কি আরও উন্নতি করা যেত না?
দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ব নেতারা বলেন, এত দিন সিপিএম তাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে শরিক দলকে যুক্ত করেছে। এ বার নেতাজির জন্মদিনকে ‘দেশপ্রেম দিবস’ ঘোষণার দাবিতে ‘জেল ভরো’ আন্দোলনে সিপিএমকে সামিল হতে হবে। বুদ্ধ-বিমানের মুখের উপরেই প্রবীণ ফব নেতা অশোক ঘোষ বলেন, সিপিএম নিজের ইচ্ছামতো বামফ্রন্ট চালিয়েছে। ৩৪ বছর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকলেও প্রায় সব সময়েই রাজ্যের অর্ধেকের বেশি মানুষ বাম-বিরোধী। ভোটে সিপিএম যত শতাংশ ভোট পেয়েছে, সব সময়েই তার থেকে অনেক বেশি আসন জিতেছে! ফলে বিরোধী পক্ষে থাকা গরিব মানুষকে কাছে টানার তেমন কোনও চেষ্টা করেনি!
সাধারণত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পরে সাংবাদিক বৈঠক হয় না। কিন্তু প্রথা ভেঙে এ দিন ফব সাংবাদিক বৈঠক করে। সেখানে অশোকবাবু, জয়ন্ত রায় ও নরেন দে নেতাজি সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া কোনও কথা বলেননি। সংসদ প্রকাশিত বইয়ে নেতাজির প্রতিকৃতি ও ছবির নিচে মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করা আছে। তার বিরোধিতা করে স্পিকারের কাছে দরবার করবে বামেরা। |