|
|
|
|
|
‘শহিদ-তনয়া’র জীবন থেমে
সেই নন্দীগ্রামের আবর্তেই
সন্দীপন চক্রবর্তী • কলকাতা |
|
বিমানসেবিকা হতে চাওয়া এক তরুণীর জীবন-উড়ান থমকে দিয়েছে নন্দীগ্রাম! আসলে থমকে দিয়েছে নন্দীগ্রাম এবং সিপিএমের যুগলবন্দি! ‘নন্দীগ্রামের মেয়ে’ আর ‘সিপিএমের ঘর’ এই পরিচয়ই তাঁর জীবনের রানওয়ে আগলে দাঁড়িয়ে পড়ল? উত্তর হাতড়াচ্ছেন কলকাতা থেকে এয়ারহস্টেসের ট্রেনিং কোর্স শেষ করা মধুশ্রী সামন্ত!
প্রায় পাঁচ বছর আগে যে ভোররাতে জমি-আন্দোলনে প্রথম ‘লাশ’ দেখেছিল নন্দীগ্রাম, সেই ভোরেই গুড় জ্বাল দেওয়ার শালতিতে চেপে তালপাটি খাল পেরিয়ে পড়িমরি পালিয়েছিলেন মধুশ্রী। তখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্রী। মধুশ্রীর বাবার নাম? নন্দীগ্রামে সিপিএমের প্রথম ‘শহিদ’, শঙ্কর সামন্ত। ভাঙাবেড়ায় খালের ধারে সেই পরিচিত বাড়িটির বাসিন্দা। ২০০৭-এর ৭ জানুয়ারি ভোর রাতে শেখ সেলিম, ভরত মণ্ডল আর বিশ্বজিতের মৃত্যুর ঘটনায় ওই বাড়ি থেকেই গুলি চলেছিল বলে অভিযোগ তুলেছিল জনতা।
এক দিকে উত্তপ্ত নন্দীগ্রাম। তারই মাঝে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছেন পিতৃহারা কন্যা। তার পরে উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে এয়ারহস্টেস ট্রেনিং কোর্স শেষ করে চাকরির প্রস্তাব এসেছিল মধুশ্রীর কাছে। কিন্তু তাঁর বৃদ্ধ দাদু-ঠাকুমা চেয়েছেন, পিতৃহারা কন্যাকে পাত্রস্থ করতে। তাঁরা একটু নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারেন তা হলে। সেই মোতাবেক হলদিয়ার ভাড়া করা বাসায় একের পর এক পাত্রপক্ষ এসেছে। সাধারণ বাঙালি বাড়ির রীতি মেনে সাজিয়ে-গুছিয়ে সম্ভাব্য পাত্রীকে পেশ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশীদের কাছে খবর নিতে গিয়ে যখনই অতিথিরা জেনেছেন, পাত্রী নন্দীগ্রাম আন্দোলনে সিপিএমের নিহত নেতার কন্যা, তাঁরা জানিয়েছেন ‘দুঃখিত’। তৃণমূলের প্রবল ‘দাপটে’র জেলায় তাঁদের বাড়ির ছেলে এমন ‘মার্কামারা’ ঘরে জামাই হয়ে যাবে, এমন ঝুঁকি নিতে পারছেন না তাঁরা!
জমি আন্দোলনের সেই দিনগুলোতে সিপিএম শিবিরের মধ্যে প্রথম আক্রান্ত হয় শঙ্করবাবুর বাড়ি। গোড়ায় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের পানের বরজ, তার পরে আগুন লাগানো হয় বাড়িতে। পুড়ে মারা যান শঙ্করবাবু। দাওয়ায় আগুন, শিয়রে মৃত্যু এই অবস্থায় সহৃদয় একটি মুসলিম পরিবারের সহায়তায় তালপাটি খাল পেরিয়ে পালাতে পেরেছিলেন মধুশ্রী, তাঁর মা এবং দাদু-ঠাকুমা। একুশ বছরের তরুণী বলছেন, “ওই রকম একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে জীবনে। চাকরি করতে গেলে একা থাকতে হবে। দাদু-ঠাকুমা তাতে রাজি নন। ওঁরা শান্তি পাবেন আমার বিয়ে হয়ে গেলে। কিন্তু সেই একটাই ঘটনা ফিরে আসে। অনেকে আসেন দেখতে। ফিরে গিয়ে কাকাদের জানান, তাঁরা পারবেন না। জানি না কত দিন চলবে এই জিনিস!” মধুশ্রীর ছোট কাকা নবকুমার সামন্তর কথায়, “গুজব রটিয়ে কিছু বাইরের লোক একটা কাণ্ড ঘটিয়ে আমাদের সকলের জীবন শেষ করে দিলেন। ভাইঝিটার কী দোষ বলুন?”
নন্দীগ্রাম আন্দোলনের ‘অবিসংবাদী নেতা’ এবং অধুনা তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীও মানছেন, মধুশ্রীর কোনও ‘দোষ’ নেই। তাঁর কথায়, “সমস্যাটা আমার জানা ছিল না। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। তখন শঙ্কর সামন্তকে নিয়ে যা-ই ঘটে থাক, তার কোনও প্রভাব তাঁর মেয়ের উপরে পড়া উচিত নয়। ওঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে জনপ্রতিনিধি হিসাবে যথাসাধ্য সাহায্য করব।” যদিও শুভেন্দুর পরবর্তী বক্তব্যেই ইঙ্গিত আছে, মধুশ্রীদের সমস্যা সহজে কাটার নয়। শুভেন্দুর মতে, “নন্দীগ্রামে আন্দোলনকারীদের যাঁরা খুন-ধর্ষণ করেছিলেন, অত্যাচার চালিয়েছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে মানুষের আক্রোশ রয়ে গিয়েছে। আন্দোলনের পরেই নিশিকান্ত মণ্ডলের (আন্দোলনকারী তৃণমূল নেতা, পরে পঞ্চায়েত প্রধান হয়ে যিনি নিহত হন) ছেলে-মেয়ের কিন্তু বিয়ে হয়েছে। তার মানে সমস্যাটা সকলের ক্ষেত্রে নয়। যাঁদের গায়ে ছাপ লেগে গিয়েছে, তাঁদেরই সমস্যা।”
এখন নবকুমারবাবু হলদিয়ায় বাসার ব্যবস্থা করে মধুশ্রীদের রেখেছেন। নন্দীগ্রাম-পর্বে নবকুমারের বিরুদ্ধেও বিস্তর অভিযোগ ছিল স্থানীয় তৃণমূলের। পঞ্চায়েত ভোটে ভাঙাবেড়া থেকে জিতেও নবকুমারের পক্ষে এলাকায় কাজ করা সম্ভব হয়নি। যদিও তাঁদের নিজেদের বক্তব্য, গোড়া থেকে তাঁরা মোটেও সিপিএমের সঙ্গে ছিলেন না। ‘যাদের জমি খাস করেছি, তাদের দলীয় আনুগত্য স্বীকার করাব’ সিপিএমের এই নীতিই এক দিন তাঁরা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০০৩ সালে তাঁরা সিপিএমের সদস্যপদ নেন। নন্দীগ্রামের তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, শঙ্করবাবুদের বাড়িতে ‘বাঙ্কার’ তৈরি করে সেখান থেকে আন্দোলনকারীদের উপরে গুলি চালানো হয়েছিল।
নবকুমারের বক্তব্য, “আমরা স্রেফ একটা গুজবের বলি হয়ে গেলাম! বাড়িতে একটা পুরনো বন্দুক ছিল। ব্যালাস্টিক টেস্ট করালেই ধরা পড়ত, ওই বন্দুক থেকে সত্যিই গুলি চলেছিল কি না।” গুজব হোক বা না হোক, সেই অতীতের ভার আজও বইতে হচ্ছে সামন্ত পরিবারকে। আপাতত পাত্রপক্ষের ‘আপ্যায়নে’র জন্য খরচ করাও তাঁদের কাছে বাহুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধুশ্রীর কথায়, “বাড়ির সবাই চেষ্টা করছেন, আমার যদি কিছু একটা হয়। কিন্তু খুব অস্বস্তি হয়। সরাসরি কেউ কিছু বলে না।
পরে ফিরে গিয়ে সেই ঘটনার কথা তোলে!”
রাজ্য রাজনীতিতে ‘পরিবর্তনে’র ধাত্রীভূমি নন্দীগ্রাম মহাকরণে পালাবদল ঘটিয়ে দিয়ে ইতিহাসে নাম তুলেছে। জমি-আন্দোলনের সেই পর্ব তাঁদের জীবনেও কী ‘পরিবর্তন’ এনে ফেলেছে, প্রতি লহমায় টের পাচ্ছেন মধুশ্রী সামন্ত। নন্দীগ্রামে সিপিএমের প্রথম ‘শহিদে’র কন্যা। |
|
|
|
|
|