মার্কিন মুলুকে তাবড় কর্পোরেট কর্তা থেকে শুরু করে রাজনীতিকরা পরামর্শ নেন তাঁর। ‘ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স’ ও রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিবের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন কিছু দিন। এ-হেন সফল অনাবাসী ভারতীয় রজত গুপ্তকে আজ গ্রেফতার করেছে এফবিআই। অভিযোগ, বিভিন্ন সংস্থার গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে শেয়ার বাজার থেকে ফায়দা লোটার এক চক্রকে সাহায্য করেছেন তিনি। ওই সব তথ্যকে কাজে লাগিয়ে নিজে শেয়ার বাজার থেকে লাভবান হয়েছেন কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছেন মার্কিন গোয়েন্দারা।
কলকাতা ছেড়ে দিল্লিতে বসবাস শুরু পাঁচ বছর বয়সে। ১৬ বছর বয়সে বাবা ও দু’বছর পর মাকে হারানোর পরে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন আইআইটি-দিল্লি থেকে। এমবিএ পড়তে ১৯৭৩-এ যান হার্ভার্ডে। ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট হিসেবে যত নামডাক এর পরের ৩৪ বছরে। প্রায় এক দশক ম্যাকিনসে অ্যান্ড কোম্পানির সিইও থাকার পর অবসর ২০০৩ সালে। এর পর প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের মতো বড় ভোগ্যপণ্য সংস্থা থেকে শুরু করে, গোল্ডম্যান স্যাক্স-এর মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাঙ্ক, অ্যামেরিকান এয়ারলাইনসের মতো বিমানসংস্থার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে থাকেন রজতবাবু।
এ পর্যন্ত কাহিনিটা উত্থানের। কিন্তু ছন্দপতন ঘটে বন্ধু রাজ রাজারত্নমের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরই। যে মামলার সূত্রে এ বছর ১ মার্চ, মার্কিন শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) রজতবাবুর বিরুদ্ধে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’-এর অভিযোগ আনে। ওই অভিযোগেরই সূত্রে আজ নিউ ইয়র্কে এফবিআইয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেন রজতবাবু।
এমন কিছু যে ঘটতে পারে, তাঁর আঁচ পাওয়া গিয়েছিল, রজতবাবুর বন্ধু রাজ রাজারত্নম গ্রেফতার হওয়ায়। বেআইনি ভাবে বিভিন্ন সংস্থার গোপন তথ্য সংগ্রহ করে শেয়ার বাজার থেকে অন্যায় ভাবে লাভ কামানোর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সম্প্রতি কারাদণ্ডও হয়েছে শ্রীলঙ্কার বংশোদ্ভূত এই মার্কিন ব্যবসায়ীর।
রজতবাবুর বিরুদ্ধে ওঠা মূল অভিযোগটা কী?
এফবিআই তাঁর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ছ’দফা অভিযোগ এনেছে। যার প্রথমটি হল, শেয়ার বাজারে জুয়াচুরির ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকা। বাকি পাঁচ দফা অভিযোগ শেয়ার বাজারে জুয়াচুরি সংক্রান্ত। আগেই অভিযোগ উঠেছিল, রজতবাবু গোল্ডম্যান স্যাক্স ও প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের গোপন তথ্য রাজারত্নমকে সরবরাহ করেছিলেন। ফলে শেয়ার দরে ওঠানামা সম্পর্কে আগাম ধারণা পেয়ে যাওয়ায় রাজারত্নমের সংস্থা গ্যালিওন ব্যবসায়িক ভাবে প্রভূত লাভবান হয়। এসইসি-ও আজ রজতবাবুর বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গ ও গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগ এনেছে আদালতে। একটি মার্কিন সংবাদপত্র জানিয়েছে, ওই তথ্য সরবরাহ করে রজতবাবু ব্যক্তিগত ভাবে লাভবান হয়েছিলেন কি না, তা এখনও জানা যায়নি। কিন্তু, কোম্পানির গোপন তথ্য বাইরের কোনও ব্যক্তিকে জানানো বেআইনি।
বিশ্ব জুড়ে প্রবল আর্থিক মন্দার মধ্যে মার্কিন অর্থনীতি যখন ঘোর সঙ্কটে, সেই সময়ই গোল্ডম্যান স্যাক্স-এ বিপুল বিনিয়োগ করেছিলেন ধনকুবের ওয়ারেন বাফে। ওবামা প্রশাসনের অভিযোগ, সেই বিনিয়োগের কথাও রাজারত্নমকে জানিয়েছিলেন রজতবাবু। যে কারণে, রাজারত্নম মামলায় অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে ওই মামলার সরকারি আইনজীবীরা রজতবাবুর বিরুদ্ধে তখন আর বিশেষ উচ্যবাচ্য করেননি। তবে সেই সময়েই রাজারত্নম ও রজতবাবুর মধ্যে কথোপকথনের টেপ আদালতে পেশ হয়েছিল। তাতে শোনা গিয়েছে, রজতবাবু গোল্ডম্যান স্যাক্স-এর পরিচালন পর্ষদের বৈঠকে আলোচিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রাজারত্নমের সঙ্গে আলোচনা করছেন।
রাজারত্নম মামলায় তখনকার মতো রেহাই পেলেও রজতবাবুর বিরুদ্ধে সংস্থার গোপন তথ্য ফাঁস করার অভিযোগে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করে সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেন রজতবাবু।
তাঁর আইনজীবীরা দাবি করেন, এসইসি-র এই প্রক্রিয়ায় রজতবাবু আদালতে জুরির সামনে নিজের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পাবেন না। রাজারত্নম মামলার অন্য অভিযুক্তরা সেই সুযোগ পেয়েছেন। গত অগস্ট মাসে রজতবাবুর বিরুদ্ধে ওই আইনি প্রক্রিয়া খারিজ করে দেয় এসইসি। রজতবাবু এফবিআই-এর কাছে আত্মসমর্পণের পরে আজ তারা ফের ওই অভিযোগগুলি নিয়ে মামলা দায়ের করেছে।
রজতবাবুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত হলে জরিমানার সঙ্গে সর্বাধিক ৫ বছর জেল হতে পারে তাঁর। আর জুয়াচুরির ৫টি মামলার যে কোনওটিতে দোষী সাব্যস্ত হলে ২০ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে তাঁর। রজতবাবুর আইনজীবী গ্যারি নাফটালিসের বক্তব্য, “সংগৃহীত তথ্য থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, রজতবাবু নির্দোষ। তিনি সততার সঙ্গে নিজের কাজ করেছেন। রজতবাবু শেয়ার বাজারে কোনও কেনাবেচা করেননি। রাজারত্নমকেও এই বিষয়ে তিনি তথ্য সরবরাহ করেননি। এই অভিযোগের বিরুদ্ধে তিনি আইনি পথে লড়াই করবেন।”
|
রজত গুপ্ত |
• ১৯৪৮-এ জন্ম কলকাতায়
• দিল্লি আইআইটি এবং হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের প্রাক্তনী
• বিশ্বের প্রথম সারির উপদেষ্টা সংস্থা ম্যাকিনসের প্রাক্তন শীর্ষকর্তা
• গোল্ডম্যান স্যাক্স, প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল-সহ বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থায় পরিচালন
পর্ষদের প্রাক্তন সদস্য
• ইন্ডিয়ান স্কুল অফ বিজনেস-এর অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা |
হেজ ফান্ড কী? |
• কম ঝুঁকিতে বেশি লাভ এই নীতিতে শেয়ার, ঋণপত্র-সহ যে কোনও বাজারে লগ্নি করে এই ধরনের সংস্থা। |
|