দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার কুলপি থানায় সোমবার যাহা ঘটিয়াছে, তাহা অরাজকতার চূড়ান্ত। হাজারখানেক মারমুখী লোক সকাল ন’টার সময় থানায় হামলা চালাইতেছে, ও সি সহ পুলিশের অফিসার ও কর্মীদের বেধড়ক প্রহার করিতেছে, সংলগ্ন পুলিশ আবাসনে ঢুকিয়া ভাঙচুর করিতেছে এমন ঘটনা ‘প্রশাসন’-এর অস্তিত্ব লইয়াই প্রশ্ন তোলে। মারমুখী জনতা নাকি ধৃত তিন দুষ্কৃতীকে পুলিশের হেফাজত হইতে বলপূর্বক ছাড়াইয়া লইতে আসিয়াছিল, তাহারা থানা লক-আপেই রহিয়াছে, এই পূর্বানুমানের ভিত্তিতে। ইহাও এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, যেখানে দুষ্কৃতীদের ছাড়াইতে জনতা পুলিশের উপর চড়াও হয়। জনতার অভিপ্রায় কি তবে এই যে, পুলিশ দুষ্টের দমন না করিয়া প্রতিপালন করুক? পুলিশকে কি তবে অতঃপর দুষ্কৃতীদের ধরপাকড় হইতে নিবৃত্ত থাকিতে হইবে? অন্যথায় জনতা পুলিশকে ‘সমুচিত শিক্ষা’ দিতে আইন নিজের হাতে তুলিয়া লইবে?
রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতে হইবে। এ ভাবে আইন নিজ-হাতে তুলিয়া লওয়ার প্রবণতা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং অঙ্কুরেই ইহার সমূল বিনাশ জরুরি। গত বছর এই কুলপিতেই রথের মেলার সময় পুলিশ এ ভাবে আক্রান্ত হইয়াছিল। আর এই জেলারই গোসাবার একটি থানা হইতে আসামিদের ছিনাইয়া লওয়ার ঘটনাও ঘটে। ওই সব ঘটনায় যাহারা সক্রিয় ভাবে জড়িত ছিল, তাহাদের কাহারও কি শাস্তি হইয়াছে? না হইলে, কেন হয় নাই? আইন হাতে তুলিয়া লওয়ার এ ধরনের ঘটনায় দুষ্কৃতীদের শাস্তি না হইলে অন্যরাও একই ধরনের অপকর্ম করিতে উৎসাহিত হয়। তাহারা জানিয়া যায়, দলের স্থানীয় নেতারা তাহাদের সুরক্ষিত রাখিবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হইতেই পুলিশকে বারংবার বলিতেছেন দুষ্কৃতী দমনে দল-পরিচয় উপেক্ষা করুন। পুলিশ প্রশাসন তাহা শুনিতেছে কি? না শুনিলে, মুখ্যমন্ত্রী তথা তাঁহার প্রশাসক সহকর্মীরা শুনিতে বাধ্য করিতেছেন না কেন? নাকি শীর্ষ নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্য প্রশাসকের নির্দেশ দলের নিচু তলায় অমান্য করার প্রবণতা শাসক দলেও দানা বাধিতেছে? অন্যথায় আগের ঘটনাগুলিতে পুলিশের দৃঢ়তার সহিত দুষ্কৃতী দমনে উদ্যোগী হইতে বাধা কোথায় ছিল? বস্তুত, পুলিশের আক্রান্ত হওয়ার কিংবা পুলিশ হেফাজত হইতে দুষ্কৃতীদের ছিনতাই করার ঘটনাগুলিতে জড়িত অপরাধীদের সময়োচিত শাস্তি দিলে সোমবার কুলপি থানার অপকাণ্ডটি হয়তো ঘটিত না। স্মর্তব্য, বিরোধী পক্ষে থাকা-কালে তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা ক্ষমতায় আসিলে পুলিশকে ‘দেখিয়া লওয়া’র হুমকি দিতেন। এমন নয় তো যে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এখন সেই সব হুমকিই বাস্তবে রূপায়িত হইতেছে? মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়তি দায়বদ্ধতা রহিয়াছে। সাধারণ ভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার দায় ছাড়াও পুলিশকে নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন ভাবে দুষ্কৃতী দমনে নিয়োজিত করার নির্দিষ্ট দায়িত্বও রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী হিসাবে তাঁহারই। এবং অতিশয় কঠোর ভাবে তাহা পালন করা দরকার। কেবল মৌখিক নির্দেশই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট হইতে পারে না। পুলিশ যাহাতে অরাজকতার আবাহনকারীদের শনাক্ত করিয়া গ্রেফতার করিতে তৎপর হয়, বিচারের জন্য আদালতেও হাজির করিতে উদ্যোগ লয়, সেটা তাঁহাকেই দেখিতে হইবে। দীর্ঘ অপশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ বিরোধী নেত্রী হিসাবে তাঁহার আন্দোলনের একটি প্রধান উপকরণ ছিল। সেই অপশাসন হইতে সুশাসনে উত্তরণ না ঘটিলে ‘পরিবর্তন’ কথামাত্র থাকিয়া যাইবে। |