এক দিকে, প্রায় সব ধরনের ঋণে ফের এক বার সুদ বৃদ্ধির আশঙ্কা। অন্য দিকে, সেভিংস অ্যাকাউন্টে জমা টাকায় সুদ বাবদ আয় বাড়ার সম্ভাবনা। আম-মধ্যবিত্তকে একই সঙ্গে আশা আর আশঙ্কায় রাখল মঙ্গলবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঋণনীতি।
সেভিংস অ্যাকাউন্টে এক লক্ষ টাকার বেশি জমায় সুদের হার নির্ধারণের স্বাধীনতা এ দিন ব্যাঙ্কগুলির হাতে তুলে দিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। নতুন নীতি কার্যকর হচ্ছে মঙ্গলবার থেকেই। এই ঘোষণার পর ইতিমধ্যেই ওই সুদের হার ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে এক লাফে ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে ইয়েস ব্যাঙ্ক। আগামী দিনে আরও কয়েকটি ব্যাঙ্কের এই একই পথে হাঁটার সম্ভাবনা।
ইউরোপ ও মার্কিন মুলুকের আর্থিক সঙ্কটের কথা মাথায় রেখে ঋণের উপর সুদ নির্ধারণের বিষয়টিতে আরও স্বচ্ছতা চায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ঋণের উপর পরিবর্তনশীল সুদের হার (ফ্লোটিং রেট) নির্ধারণ নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। শীর্ষ ব্যাঙ্ক চায়, এই সুদের হার নির্ধারণে স্বচ্ছতা আসুক। ব্যাঙ্কগুলি তা এমন ভাবে ঠিক করুক, যাতে ঝুঁকি কমে ওই ঋণ সুরক্ষিত হয়। পাশাপাশি, অবিচারের শিকার না-হন গ্রাহকেরা। এই লক্ষ্যে এ দিন একটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (কর্মী গোষ্ঠী) গড়ার প্রস্তাব দিয়েছে শীর্ষ ব্যাঙ্ক। |
তবে সেভিংস অ্যাকাউন্টে সুদ বৃদ্ধির সম্ভাবনা খুশির খবর হলে আশঙ্কার বিষয় হল: আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানতে এ দিনও সুদ বৃদ্ধির পথেই অবিচল থাকল রিজাভর্র্ ব্যাঙ্ক। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে স্বল্পকালীন মেয়াদে দেওয়া ধারে সুদের হার (রেপো রেট) ফের ২৫ বেসিস পয়েন্ট (০.২৫ শতাংশ) বাড়ানোর কথা ঘোষণা করল তারা। গত ২০ মাসে এই নিয়ে মোট ১৩ বার। তবে শীর্ষ ব্যাঙ্কের ইঙ্গিত এবং বিশেষজ্ঞদের আশা সত্যি হলে, আগামী বেশ কয়েক মাসে আর বাড়বে না সুদের হার।
শীর্ষ ব্যাঙ্কের পথে হেঁটে মঙ্গলবারই ইয়েস ব্যাঙ্ক ছাড়া অন্য কোনও বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক সুদ বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেনি ঠিকই। তবে অচিরে গৃহ ঋণ, গাড়ি ঋণ, শিল্প ঋণ-সহ প্রায় সব ধরনের ঋণেই সুদের হার বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। যদিও একই সঙ্গে মেয়াদি আমানতে ফের সুদ বৃদ্ধির সম্ভাবনাও এর ফলে উজ্জ্বল হল বলে ব্যাঙ্ককর্তাদের অভিমত।
গৃহ ঋণে ফের সুদ বাড়ার আশঙ্কার দিনেই অবশ্য বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাটের সন্ধানে থাকা সাধারণ মানুষকে ‘সুখবর’ দিয়েছে কেন্দ্র। এখন থেকে ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত গৃহ ঋণে এক শতাংশ সুদ ভর্তুকি দেবে তারা। এত দিন পর্যন্ত যা দেওয়া হত ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের ক্ষেত্রে। একই সঙ্গে, মেয়াদ ফুরনোর আগেই ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া গৃহ ঋণের টাকা ফেরানোর জন্য দেয় জরিমানা অদূর ভবিষ্যতেই তুলে দেওয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। গৃহ ঋণ সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে যে নিয়ম চালু হবে বলে আগেই জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যাশনাল হাউজিং ব্যাঙ্ক।
নির্মাণ সংস্থাগুলির সংগঠন ‘ক্রেডাই’ অবশ্য মনে করছে, এতে চিড়ে তেমন ভিজবে না। কারণ, এক সঙ্গে দু’দিক থেকে সমস্যার মুখে পড়বেন ফ্ল্যাট বা বাড়ি কিনতে আগ্রহী সাধারণ মানুষ। এক দিকে সুদ বৃদ্ধির ফলে ফের বাড়বে গৃহ ঋণের মাসিক কিস্তির অঙ্ক। আবার তার সঙ্গেই আরও বাড়বে ফ্ল্যাট বা বাড়ির দাম। কারণ, আবাসন প্রকল্প গড়তে নেওয়া ঋণে সুদ বাড়ায়, বাড়ির দাম বাড়াতে বাধ্য হবে নির্মাণ সংস্থাগুলি। ফলে তাদের মতে মাথার উপর ছাদ জোগাড় করা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের নাগালের আরও বাইরে চলে যাওয়ারই সম্ভাবনা। মাসিক কিস্তি বেড়ে বিক্রি কমলে, জোরালো ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা করছে গাড়ি শিল্পমহলও।
অন্য দিকে, টানা আট বছর অপরিবর্তিত
রাখার পর গত মে মাসে সেভিংস অ্যাকাউন্টে জমা টাকার উপর সুদের হার ৩.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। এই হার নির্ধারণের স্বাধীনতা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা অনেক দূর এগোলেও, এত দিন পর্যন্ত একচেটিয়া ভাবে তা ছিল শীর্ষ ব্যাঙ্কের হাতেই। কিন্তু এখন থেকে সেভিংস অ্যাকাউন্টে শুধু এক লক্ষ টাকার কম আমানতের জন্যই সুদ বেঁধে দেবে তারা।
তুলনামূলক কম খরচে তহবিল সংগ্রহের জন্য সেভিংস অ্যাকাউন্টের আমানত বরাবরই ব্যাঙ্কগুলির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এ বার সেখানেও সুদ বাড়াতে বাধ্য হলে সেই তহবিল সংগ্রহের খরচ এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যাবে বলে ব্যাঙ্ক কর্তাদের আশঙ্কা। বিশেষত যখন গত দেড় বছরেরও বেশি সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে দেওয়া ধারে লাগাতার সুদ বাড়িয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভাস্কর সেনের মতে, “এর ফলে ঋণে সুদ বাড়াতে বাধ্য হতে পারে ব্যাঙ্কগুলি।” এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর দেবব্রত সরকার মনে করেন, “এর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে ব্যাঙ্কগুলির মুনাফার উপর।” ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞ এবং ইউকো ব্যাঙ্কের প্রাক্তন এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর বি কে দত্ত বলেন, “সেভিংস অ্যাকাউন্টে সুদ ধার্য করার সময় ব্যাঙ্কগুলিকে তাদের সব থেকে স্বল্পমেয়াদি স্থায়ী আমানতের উপর দেওয়া সুদের হারের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে যে, মেয়াদি আমানতে কর (টিডিএস) কাটা হলেও, সেভিংস অ্যাকাউন্টে তা করা হয় না।”
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অবশ্য মনে করে, সেভিংস অ্যাকাউন্টে সুদ বাড়লে বাজার থেকে বাড়তি নগদের একটি বড় অংশ যাতে ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারে আসার সম্ভাবনা। ঠিক যে কারণে বৃদ্ধির হার কমার ঝুঁকি মাথায় নিয়েও এ দিন ফের সুদ বৃদ্ধির রাস্তায় হেঁটেছে তারা। এ দিন ঋণনীতি পর্যালোচনায় ২৫ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধির দরুন ৮.৫ শতাংশে পৌঁছেছে রেপো রেট (স্বল্পকালীন মেয়াদে ব্যাঙ্কগুলি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে যে সুদে ঋণ পায়)। স্বাভাবিক ভাবেই, রিভার্স রেপো রেট (বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির কাছ থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে হারে ঋণ নেয়)-ও ২৫ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে পৌঁছেছে ৭.৫ শতাংশে। সাধারণ ভাবে অর্থনীতির যুক্তি বলে, আমানতে সুদ বাড়লে, ব্যাঙ্কে অপেক্ষাকৃত বেশি টাকা গচ্ছিত রাখেন সাধারণ মানুষ। এই সঞ্চয়ের দরুন খরচের জন্য হাতে রাখা টাকার পরিমাণ কমে। ফলে টাকার জোগান কমে বাজারে। রাশ টানা যায় মূল্যবৃদ্ধিতে। কিন্তু এই যুক্তিতে যে তিনি খুব একটা সন্তুষ্ট নন, এ দিনও তা ফের এক বার স্পষ্ট করে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “সুদ বাড়ার দরুন মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম টানা হয়তো সম্ভব হবে। কিন্তু একই সঙ্গে ধাক্কা খাবে আর্থিক বৃদ্ধির গতিও।” |