শ্যামাসঙ্গীত যেন শুধু
শ্যামাপুজোতেই জীবন্ত
সেই সব মন কেমন করা গান তোরঙ্গ থেকে আজ বেরিয়ে আসবে আবার। শুধু চব্বিশ ঘণ্টার জন্য। পাড়ার মাইকে। রাত ফুরোলে তার জায়গা আবার হবে ঘরের তাকে। ধুলো জমবে।
শ্যামাপুজোয় মূর্তি প্রতি বার নতুন। শ্যামাসঙ্গীতে পুরনোরই জয়ধ্বনি। শ্যামাসঙ্গীত কি তা হলে মহালয়ার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানের মতো হয়ে দাঁড়াল? এক দিনের জন্যই তার কদর?
কালীপুজোর আগের দিন শহরের বড় বড় গানের দোকানে হানা দিয়ে দেখা গেল, টপ চার্টের একটাতেও শ্যামাসঙ্গীত নেই। পার্ক স্ট্রিটের মিউজিক ওয়র্ল্ডে সেরা দশের মধ্যে পাঁচটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। একটা সেই চিরন্তন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’, একটা বাংলা ব্যান্ড, একটা সিনেমার গান, একটা আধুনিক। কিন্তু শ্যামাসঙ্গীত অদৃশ্য। কালীপুজোর আগের দুপুরেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিডি উদ্বোধনে ব্যস্ত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও পরিচালক গৌতম ঘোষ।
রামপ্রসাদ থেকে রবীন্দ্রনাথ, কমলাকান্ত থেকে নজরুল চির কালের বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ শ্যামাসঙ্গীত। এই পুজোয় যখন আধুনিক গানের জায়গা অনেকটাই দখল করে নিল রবীন্দ্রসঙ্গীত, শ্যামাসঙ্গীতের নতুন সিডি প্রায় দুষ্প্রাপ্য। এখনও কালীপুজোয় বাজছে পান্নালাল বা ধনঞ্জয়। ঘুরে ফিরে আসছে কয়েকটি গান। ‘আমার সাধ না মিটিল’, ‘দোষ কারও নয় গো মা’, ‘সদানন্দময়ী কালী’, ‘শ্যামা মা কি আমার কালো’, ‘আমার চেতনা চৈতন্য করে’, ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে’, ‘আমার মায়ের নামটি দয়াময়ী’ বা ‘চাই না মাগো রাজা হতে’। মুম্বইয়ের কুমার শানু বা অনুরাধা পৌডওয়ালও এগুলোই রিমেক করেছেন।

ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য

পান্নালাল ভট্টাচার্য
নজরুলগীতির মতো শ্যামাসঙ্গীতও কি হারিয়ে যেতে বসল? শুধু নজরুলগীতি গেয়ে চলা নামী গায়ক যেমন এখন দুর্লভ, শুধু শ্যামাসঙ্গীত গায়কও তাই। পান্নালাল ভট্টাচার্য, কে মল্লিক, মৃণালকান্তি ঘোষ বা হীরালাল সরখেলের মতো শুধু শ্যামাসঙ্গীতের জন্যই জনপ্রিয় হওয়া গায়ক এখন বাংলা গানের বাজারে নেই। রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, অমৃক সিংহ অরোরা চলে যাওয়ার পরে শ্যামাপুজোর অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় গায়ক পাওয়া কঠিন এখন। ধনঞ্জয়ের ছেলে, পান্নালালের ভাইপো দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলছিলেন, “বাবা-কাকার কাছে কালীপুজোর আগের তিন দিন থেকে পরের দিন পর্যন্ত পনেরো থেকে কুড়িটা অনুষ্ঠানে গাওয়ার আমন্ত্রণ আসত। বাবাকে কালীপুজোর আগের দিন আটটা অনুষ্ঠানও করতে দেখেছি। এখন সে সব কোথায়?”
এক যুগ আগে ‘মা’কে নিয়ে যাঁর সিডি সুপারহিট হয়েছিল, সেই মান্না দে-র সাফ কথা, “ভক্তিগীতি আসলে একটা ছোট অংশ শোনে। যাদের বয়স পঞ্চাশের বেশি।” ‘রামকৃষ্ণায়ন’ গীতিনাট্যে অনেক শ্যামাসঙ্গীত অন্য সুরে জনপ্রিয় করা মান্না নিজে পরিচিত সুরে শ্যামাসঙ্গীত গাওয়ার পক্ষপাতী নন। বাংলার প্রবীণতম গায়ক বেঙ্গালুরু থেকে বললেন, “রেকর্ড কোম্পানি বড় অংশের কথা ভাবে। আর এই শ্রোতারা কী রকম গান চান, সেটাই কেউ জানে না। একটা সময় রবীন্দ্রসঙ্গীতের থেকেও আমার নজরুলগীতি গাইতে ভাল লাগত। অনেক স্বাধীনতা ছিল। সেই নজরুলগীতিও এখন বেশি হয় না।”
এই দীপাবলিতে তবে বাঙালির জন্য নতুন শ্যামাসঙ্গীত কী থাকল? এইচএমভি থেকে দুটো সিডি বেরিয়েছে। একটা পুরনো গানের সঙ্কলন, একটা স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্তের ভক্তিগীতি। সব জায়গায় ঘুরেফিরে আসছে পান্নালাল বা ধনঞ্জয়ের রামপ্রসাদী। অন্য একটি সংস্থা থেকে বেরিয়েছে অজয় চক্রবর্তীর ভক্তিগীতির ভিডিও সিডি। আছে মনোময় ভট্টাচার্য ও অন্বেষার যৌথগান। কালী-কীর্তনের সিডিও পাবেন। ইন্দ্রাণী সেন অন্য তিন শিল্পীর সঙ্গে শ্যামাসঙ্গীতের সিডি প্রকাশ করছেন ক’দিন পরে। তাঁর মন্তব্য, “শ্যামাসঙ্গীতকে আলাদা করে দেখলে চলবে না। নতুন আধুনিক গানের বাজার নেই। নজরুলগীতির নেই। ছড়ার গান আগে এত জনপ্রিয় ছিল, এখন নেই।”
তবে এইচএমভি-র গানের দীর্ঘ দিনের সঙ্কলক অমল বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মানতে নারাজ যে, শ্যামাসঙ্গীতের বাজার নেই। তাঁর যুক্তি, “শ্যামাসঙ্গীতের পুরনো সিডি ভালই বিক্রি হয়। হিন্দিতে রাম বা কৃষ্ণের উপর গান যেমন জনপ্রিয়, বাংলায় সেটা নেই। ভক্তিগীতি বলতে বাংলায় শ্যামাসঙ্গীতই। তবে বলতে পারেন, নতুন শ্যামাসঙ্গীত গাওয়ার গায়ক নেই।” রাসবিহারী মোড়ের ‘মেলোডি’তে শঙ্কর আচার্য বলছিলেন, “সারা বছরই টুকটাক বিক্রি হয় শ্যামাসঙ্গীত। পান্নালাল-ধনঞ্জয়ের গানই বেশি।” শ্রীকান্ত আচার্য বছর দশেক আগে ‘সাধনাঞ্জলি’ নামে মাতৃসঙ্গীত করেছিলেন। এখনও তার ভাল বিক্রি। শ্রীকান্তের ব্যাখ্যা, “দুর্গাসঙ্গীত বা সরস্বতীসঙ্গীত বলে কিছু হয়নি, শ্যামাসঙ্গীত হয়েছে। হয়তো আপাতত অন্য গানের গুঁতোয় পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু সারা বছর প্রচুর শ্যামাসঙ্গীত রেকর্ডিং হয়।”
কলেজ স্ট্রিটের দুই ভট্টাচার্যর বড় জন কালীপুজো করতে করতে কেঁদে উঠতেন। অন্য জন শ্মশানে গিয়ে কাঁদতেন। পান্নালাল সিনেমায় ভক্তিগীতি গাইতেন না। ধনঞ্জয় আবার সিনেমার বাইরে শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন না। পান্নালাল মারা যাওয়ার অনেক দিন বাদে বহু অনুনয়-বিনয়ের পরে ধনঞ্জয় গাইতে রাজি হয়েছিলেন। শ্রীকান্ত আচার্য নিজে কালীপুজোর আগের দিনও দুপুরে বাড়িতে চালিয়েছিলেন পান্নালাল। “কিছু গান সাধারণের জন্য হয় না। শ্যামাসঙ্গীত থাক না বিশেষ শ্রেণির জন্য। কোণঠাসা হতে পারে, কিন্তু হারিয়ে যাবে না।” বললেন তিনি।
ওই আশা নিয়েই আজ, একটা দিনের জন্য প্রাণ পাচ্ছে শ্যামাসঙ্গীত।
 



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.