নিজস্ব বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ার সরকারি অনুমোদন পেলেই যে সাহাগঞ্জের ডানলপ কারখানা পুরোপুরি চালু হয়ে যাবে, তা মনে করছেন না সেখানকার শ্রমিকেরা। তাঁদের অনেকেরই ধারণা, এই প্রস্তাব মালিক পক্ষের ‘ভাঁওতাবাজি’। বিদ্যুৎ কর্তারাও সরাসরি জানিয়েছেন, কারখানা কর্তৃপক্ষের এমন ভাবনা ‘অলীক ও অবাস্তব’।
বস্তুত, সাহাগঞ্জ কারখানার সমস্যা মেটানোর পথ খুঁজতে শুক্রবার আলোচনায় বসে সংস্থার পরিচালন পর্ষদ। বৈঠকের পরে রুইয়া গোষ্ঠীর কর্ণধার পবন রুইয়া ঘোষণা করেন, নিজস্ব বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সরকারি অনুমোদন মিললে কারখানা পুরোপুরি চালু করার শেষ চেষ্টা
করবেন তাঁরা। তিনটি পর্যায়ে কারখানা চালু করার
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
শনিবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হতে দেখে শ্রমিকেরা ধরে নিয়েছিলেন, এ দিন থেকেই কারখানা খুলবে। কিন্তু সকলেই হতাশ হন। সকাল ৬টাতেই কারখানার পূর্ব দিকের গেটের সামনে কয়েকশো শ্রমিক জড়ো হন। চলে আসেন শ্রমিক-নেতারাও। কিন্তু দুপুর ১২টাতেও কারখানার গেট খোলেনি। এর পরেই হতোদ্যম হয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শ্রমিকেরা। তাঁদের সেই ক্ষোভের মুখে পড়েন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও।
‘আর্থিক অনটন, শ্রমিকদের মধ্যে উচ্ছঙ্খলতা এবং কাঁচামাল আমদানি করতে না পারা’-কে কারণ হিসাবে দেখিয়ে ওই গেটেই গত ৮ অক্টোবর সকালে ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’-এর নোটিস ঝুলিয়ে দেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। সমস্যায় পড়েন কারখানার ৮৭২ জন স্থায়ী এবং ৪৫০ জন অস্থায়ী শ্রমিক। সেই বিজ্ঞপ্তি এ দিনও ঝুলছিল। কারখানা খোলার দাবিতে ইতিমধ্যে সিটু, আইএনটিইউসি এবং আইএনটিটিইউসি এক ছাতার তলায় চলে এসেছে। তিনটি সংগঠন মিলিত ভাবে গড়েছে ‘জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি’। দিন কয়েক আগে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর সঙ্গে বৈঠকে বসেন সংস্থার প্রতিনিধিরা। রাজ্য সরকার দ্রুত কারখানা খুলে আলোচনার নির্দেশ দেয়।
এই পরিস্থিতিতেই শুক্রবার আলোচনায় বসে সংস্থার পরিচালন পর্ষদ। কারখানাটিকে লাভজনক ভাবে চালানোর জন্য নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে চান কর্তৃপক্ষ। তাঁদের যুক্তি, নিয়ম অনুযায়ী ওই কেন্দ্র তৈরি হলে, তার ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের গ্রিডে দেওয়া যাবে। ওই কেন্দ্রে ইউনিট-পিছু বিদ্যুৎ তৈরির খরচ কত, তা নির্ধারণ করবে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। ওই খরচের সঙ্গে আরও ১৭ শতাংশ বাড়তি দাম ধরে তা গ্রিডে দিতে পারবে সংস্থা। মনে করা হচ্ছে, এই প্রকল্প গড়তে পারলে প্রায় শূন্যে এসে দাঁড়াবে কারখানার প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের খরচ। একই সঙ্গে, আয়ের পাকা রাস্তাও তৈরি করতে পারবে সংস্থা।
সংস্থার এই পরিকল্পনা আদৌ কতটা লাভজনক হবে, সে বিষয়ে বিদ্যুৎ-কর্তারা সন্দিহান। তাঁরা জানান, বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থা যে মাসুল হারে ডানলপকে বিদ্যুৎ বিক্রি করে, তার চেয়ে নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুতের ব্যয় ঠিক কতটা কম হবে, তা স্পষ্ট করছেন না ডানলপ কর্তৃপক্ষ। টায়ার কারখানায় মোট উৎপাদন ব্যয়ের মধ্যে বিদ্যুৎ বাবদ ব্যয় দশ শতাংশেরও কম। কাজেই, বিদ্যুৎ-মাসুলের সামান্য হেরফেরে কারখানা কেমন করে লাভজনক হয়ে উঠবে, তা বোধগম্য হচ্ছে না।
এর পাশাপাশি, বিদ্যুৎ কর্তারা জানিয়েছেন, কেবল পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র পেলেই বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে ফেলা যায় না। চাই কয়লা ও জলের পর্যাপ্ত জোগান। সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কী ভাবছেন, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া, বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য জল, কয়লা ও পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্রের ব্যবস্থা হয়ে গেলেও ওই কেন্দ্র থেকে উৎপাদন শুরু হতে তিন-চার বছর লাগবেই। তত দিন কারখানা কী ভাবে চলবে, সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কিছু ভেবেছেন কিনা, তারও কোনও দিশা নেই।
এ দিন কারখানার গেট খুলতে না দেখে হতাশ টায়ার বিভাগের কর্মী সজলকুমার পাল বলেন, “এত দিন ধরে অনেক ভাঁওতা দেওয়া হয়েছে। ফের নতুন ভাঁওতা দেওয়া হচ্ছে। আমরা আর সেই ফাঁদে পা দেব না। আগে শ্রমিকদের কাজে নিতে হবে এবং আমাদের বকেয়া মেটাতে হবে। তবেই সব প্রকল্প আমরা মেনে নেব।” রবার বিভাগের কর্মী বিজয়কুমার রাম বলেন, “মালিকের এই শর্ত মানছি না। আমরা চাই আগে কারখানা খুলুক। তার পরে যা কিছু হোক।” আর এক কর্মী নরেশকুমার মিত্র বলেন, “আমরা চাই, আগে সাসপেনশন অব ওয়ার্কের নোটিস তুলতে হবে। শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করে বাকি প্রকল্প চালু করতে হবে।” একই বক্তব্য শ্রমিক সংগঠনগুলিরও। |