মহালয়ার সন্ধেয় ‘বসে আঁকো’র পুরস্কার তুলে দিয়ে ক্লাবের বড়রা বলেছিলেন, ‘‘জানিস, চার বছরের ছেলেটার খুব অসুখ। সব সময় শুয়ে থাকে। খেলতেই পারে না। শুধু ওষুধ খায়। গরিব তো, মাঝে মাঝে তা কিনতেও পারে না।’ প্রস্তাবটা সেই সময়েই ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল, “চল, ওর জন্য পুজোয় চাঁদা তুলি!”
বড়রা এ সব কথা বলার সময়েই ঠাকুমার কোলে চড়ে ক্লাবের সামনে হাজির হয়েছিল বছর চারেকের গোলগাল সেই ছেলেটি। অজয় দেবনাথ। তাকে দেখেই মন খারাপ হয়ে গেছিল সৌম্যদীপ, অঙ্কিতা, সুকৃতী, জিনিয়াদের। ওরা নবদ্বীপের রানিরচড়ায় থাকে। কেউ চতুর্থ কেউ বা অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া। সৌম্যদীপ তাদেরই এক জন। সে বন্ধুদের বলে, “কী ছটফটে বাচ্চা, অথচ দেখ চিকিৎসা না করালে ক’দিন পরেই মারা যাবে। চল না, ওর জন্য চাঁদা তুলি!”
অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার সময়ে ইন্দ্রনীলের হাত চেপে ধরে ছিল ক্লাস সেভেনের সৌম্যদীপ। তার কথা শুনে চক চক করে উঠেছিল ইন্দ্রনীলের চোখ। হোক না ক্লাস সিক্স, তালু দিয়ে চোখ মুছে সে বলে উঠেছিল, “চল, পাড়ার অন্যদেরও বলব পুজোর সময়ে চাঁদা দিতে। নিশ্চয় কিছু করতে পারব।”
|
অজয় দেবনাথ |
পাড়ার রাস্তা ধরে ঘরে ফেরা সেই সন্ধেয়, স্থানীয় বকুলতলা হাইস্কুলের দুই খুদে পড়ুয়ার প্রবল সদিচ্ছাতে জীবনদায়ী যে কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল, এখনও তা শেষ হয়নি। সৌম্যদীপ বলে, “ওইটুকু ছেলেটা বাঁচবে না, ভাবতেই পারছি না!” পরের দিন সকাল থেকেই অঙ্কিতা, জিনিয়া, সুমনদের বোঝাতে শুরু করেছিল সে। তার কথায়, “শুধু আমাদের পাড়ায় নয়। অন্য পাড়ার বন্ধুদেরও বলেছিলাম, পুজোয় আমাদের পুজো মণ্ডপে আসিস। আর, যা পারিস চাঁদা দিবি। অজয়ের জন্য।” ইন্দ্রনীল বলে, “অজয়ের একটা ছবি জোগাড় করে তা দিয়ে একটা পোস্টার বানানোর চেষ্টা করেছিলাম। পাড়ার ক্লাবের দাদারা তা দেখে নিজেরাই ফ্লেক্স বানিয়ে দিল। সেটা নিয়েই আমরা চাঁদা তুলেছি। রোজ।” আর দ্বিতীয় শ্রেণির পূজা বলছে, “পুজোর ক’দিন বাবা রোজ দশ
টাকা করে দিয়েছিলেন আইসক্রিমের জন্য। একটাও খাইনি।
চাঁদা দিয়েছি।”
ষষ্ঠী থেকে দশমী, পাঁচ দিন ‘আজাদ হিন্দ’ ক্লাবের পুজোমণ্ডপে পালা করে তাই ‘চাঁদা-ডিউটি’ দিয়েছে ওই খুদেরা। কখনও বা ছবি নিয়ে ঘুরেছে পাড়ায়। অজয়ের বড়সড় ছবিটা দেখিয়ে সাহায্য চেয়েছে। আর তাতেই উপচে উঠেছিল খান তিনেক লক্ষ্মীর ভাঁড়। ওই ক্লাবের শুভাশিস কংসবণিক বলেন, “আমরা অজয়ের সাহায্যের জন্য ছোটদের বুঝিয়েছিলাম। গোটা পুজোয় ওরা তাই সব ফেলে রেখে টাকা তুলেছে। ছোটরা যে এত ‘বড়’ হয়ে গিয়েছে, বুঝতেই পারিনি!” লক্ষ্মী পুজোর সন্ধ্যায় সেই ভাঁড় ভাঙতেই ছড়িয়ে পড়েছে হাজার চারেক টাকা। ঠোঁট কামড়ে কাঁদতে থাকা অজয়ের মা-ঠাকুমার হাতে সেই টাকা তুলে দিয়েছে সৌম্যদীপেরা। |
নবদ্বীপ রানিরচড়ার বাসিন্দা লক্ষ্মী ও কামাক্ষ্যা দেবনাথের ছেলে অজয়ের কিডনির অসুখ ধরা পড়ে বছর দেড়েক আগে। কলকাতা, চেন্নাই ঘুরে লাখ দুয়েক টাকা খরচ করে জানা গিয়েছিল, কিডনি দুটোর অবস্থা ভাল নয়। কিডনি বদলাতে প্রয়োজন কয়েক লক্ষ টাকা।
অজয়ের বাবার তেমন রোজগার নেই। অন্যের বাড়ি রান্নার কাজ করেন ঠাকুমা লক্ষ্মীরানিদেবী। নাতির জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। লক্ষ্মীরানি বলেন, “আমাদের সামান্য যা গয়না ছিল আর এক টুকরো জমি সব বিক্রি করে দেড় বছর ধরে চিকিৎসা চালিয়েছি। পাড়া-পড়শিরা নানা ভাবে সাহায্য করেছেন। বিধায়ক তহবিল থেকে মিলেছে দশ হাজার। ব্যাস। কিন্তু কিডনি পাল্টানোর টাকা কোথায়? ফলে অজয়ের আয়ু এখন সকলের সাহায্যের উপরেই নির্ভর করছে।”
বাবা কামাক্ষ্যাবাবু বলেন, “বিধানচন্দ্র শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে অজয়ের। চিকিৎসকেরা বলেছেন, একটা কিডনি নষ্ট। অন্যটা ঠিক রাখতে গেলে ১৫ বছর পর্যন্ত নিয়মিত ওষুধ এবং মাসে মাসে রক্ত দিতে হবে। মাসে তিন হাজার টাকা নিয়মিত খরচ। জানি না কী করে পারব।”
“ঠিক পারব। আমার এতগুলো নাতি-নাতনি আছে না, ওরাই অজয়কে বাঁচিয়ে রাখবে”, সৌম্যদীপকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন লক্ষ্মীরানি।
হোক না সামান্য চার হাজার। লক্ষ্মীরানির এক চিলতে উঠোনে কোজাগরী জ্যোৎস্না যেন ফেটে পড়ছে!
|