সহযোগিতা চেয়ে পেলেন কষাঘাত
হযোগিতার আর্জি জানিয়ে বেনজির সমালোচনার মুখোমুখি হলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
আজ জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের মঞ্চ থেকে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজনৈতিক বিরোধিতাকে সরিয়ে রেখে ঐকমত্য গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। মন্দা, দুর্নীতি ও অণ্ণার আন্দোলনের ফলে দেশ জুড়ে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে যে ‘নেতিবাচক মনোভাব’ তৈরি হয়েছে, তা বদলাতে তিনি সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদেরই সাহায্য চেয়েছিলেন। ফল হয়েছে উল্টো। মনমোহন-সরকারের আর্থিক নীতির সমালোচনায় ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভাঙার অভিযোগ তুলে কেন্দ্রের কড়া সমালোচনা করেছেন নরেন্দ্র মোদী, শিবরাজ সিংহ চৌহাণ এবং নীতীশ কুমাররা। অনুপস্থিত থাকলেও আক্রমণে পিছিয়ে থাকেননি জয়ললিতা ও মায়াবতী।
কার্যত আক্রমণের ধারে সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছেন জয়ললিতা। তিনিও অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু নিজের বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ত’ ও ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে আখ্যা দিয়ে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলি ছাড়া অন্য রাজ্যের বাসিন্দাদের ভারতীয় নাগরিক বলেই মনে করে না কেন্দ্র। সমস্ত সাংবিধানিক পদ ও প্রতিষ্ঠান যাতে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ধর্ম ক্ষুণ্ণ না হয়, সে বিষয়ে কেন্দ্রকে সতর্ক করেছেন নরেন্দ্র মোদী। আর নীতীশ অভিযোগ তুলেছেন, রাজ্যগুলির জন্য কেন্দ্রীয় অর্থ সাহায্যের পরিমাণ যে ভাবে কমে আসছে, তা যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থ কাঠামোর পরিপন্থী।
বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রীদের অভিযোগের জবাবে প্রধানমন্ত্রী দিনের শেষে বলেছেন, কংগ্রেস শাসিত হোক বা না হোক, কেন্দ্র কোনও রাজ্যের সঙ্গেই বৈষম্য করে না। তাঁর বক্তব্য, এটা শুধুই ধারণা, বাস্তব নয়। স্বচ্ছ ভাবে সকলকেই সাহায্য করতে কেন্দ্রীয় সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আজকের বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল, দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার জন্য যোজনা কমিশনের তৈরি ‘অ্যাপ্রোচ পেপার’ বা খসড়া নীতি। যার মূল মন্ত্র হল, ‘সকলের জন্য দ্রুত, দীঘর্স্থায়ী ও আরও বেশি উন্নয়ন’। দিনের শেষে সেই খসড়া নীতি পাশ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যগুলির সম্পর্কের শতচ্ছিন্ন ছবিটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে রাজ্যগুলির মুখে দাবি দাওয়া, অভাব-অভিযোগ, সমালোচনার সুর নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অখণ্ড ধারণা নিয়ে প্রশান্ত মহালানবিশের নেতৃত্বে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। তৈরি হয়েছিল জাতীয় উন্নয়ন পরিষদ। কিন্তু কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বরাবরই বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলি অভিযোগ তুলে এসেছে। রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে সামগ্রিক ভাবে জাতীয় স্বার্থের কথা কমই ভাবা হয়েছে। আজ তারই শিকার মনমোহন সিংহও। মনমোহন নিজেও তা জানতেন। তাই সম্মেলনের শুরুতেই তিনি মেনে নেন, “রাজনৈতিক দলগুলি নিজের অবস্থানও বজায় রাখবে, আবার দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা ভেবে সহযোগিতার হাতও বাড়াবে, এই ভারসাম্য বজায় রাখা দুঃসাধ্য।” তা সত্ত্বেও পৃথিবী জুড়ে আর্থিক মন্দার ফলে এ দেশেও যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে, তা বদলানো ‘সকলেরই দায়িত্ব’ বলে যুক্তি দেন মনমোহন।
সেই দায়বদ্ধতা নিয়ে অবশ্য কাউকেই মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রীরা সমবেত ভাবে অভিযোগ তুলেছেন, সকলের জন্য উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে সমস্ত কেন্দ্রীয় প্রকল্পের আর্থিক দায় রাজ্যগুলির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নীতীশ কুমার বলেন, খাদ্য সুরক্ষা আইনের মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পে কত জন সুবিধা পাবে, কী পাবে, তা ঠিক করছে কেন্দ্র। কিন্তু তার একটা বড়সড় আর্থিক বোঝা চাপবে রাজ্য সরকারের উপর। জয়ললিতার অভিযোগ, এই ভাবে রাজ্যগুলিকে দুর্বল করে দিয়ে পুরসভার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্র। সম্মেলনের আগে গুজরাতে রাজ্যপালের লোকায়ুক্ত নিয়োগ করা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী ট্যুইট করে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করবেন না। বৈঠকে সেই অভিযোগ তোলার পাশাপাশি মোদী ইউপিএ-র সমালোচনা করে বলেন, দুর্নীতির ফলে প্রশাসনের উপর মানুষের বিশ্বাস নড়ে গিয়েছে। বৈঠকের বিরতিতে ‘প্রণব-চিদম্বরম সংঘাত’ নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে রসিকতা করে বলেন, “চুইংগামে দু’টো জিনিস জুড়ে যায়। আপনার সরকারের দু’জন চুইংগামে আলাদা হয়ে গিয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গ নেই কেন, তা নিয়েও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি মোদী। তিনি বলেন, মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাড়ির মহিলা (অওরত)-দের উপরেই চাপ পড়ে। কিন্তু এই সরকার তো ‘আম আদমি’র সরকার, ‘আম অওরত’-এর সরকার নয়। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রের ব্যর্থতা নিয়ে সরব হয়েছেন জয়ললিতাও। একমাত্র বামশাসিত রাজ্য ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের যুক্তি, কেন্দ্রের ভুল নীতিতেই আঞ্চলিক বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশের অভিযোগ, রাজ্যের জন্য বিশেষ সাহায্যের দাবি খারিজ করে দিয়েছে কেন্দ্র। আর জয়ললিতা জানিয়েছেন, এই ধরনের ‘আনুষ্ঠানিক’ বৈঠকের শেষে হতাশাই তৈরি হয়। কারণ রাজ্যগুলির যুক্তিপূর্ণ দাবিতেও কেন্দ্র কান দেয় না। রাজ্য সরকারকেই মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়।
রাজ্যগুলির তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সকলকে এক সুরে বাঁধার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। বৈঠকের মাঝে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও সেই চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সাহায্যের অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানান, নতুন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কেন্দ্রীয় মদতপুষ্ট প্রকল্পগুলির কাঠামো পরিবর্তন করার সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে যোজনা কমিশনের নিযুক্ত কমিটির রিপোর্টে মুখ্যমন্ত্রীদের মতামত চাওয়া হয়েছে।
যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ মন্টেক সিংহ অহলুয়ালিয়া বলেন, অভিন্ন পণ্য পরিষেবা কর চালু হলে রাজ্যগুলির আয় বাড়বে। কিন্তু জয়ললিতার নালিশ, পণ্য পরিষেবা কর নিয়েও রাজ্যগুলির আশঙ্কায় গুরুত্ব না দিয়ে ভ্যাট বসানোতে রাজ্য সরকারের ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে কেন্দ্র। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহাণও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান চেহারায় পণ্য পরিষেবা কর বিল তিনি মানছেন না।
যোজনা কমিশনের ওই খসড়া নীতিতে ২০১২-১৭ মেয়াদ কালে আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে ৯ শতাংশ। কিন্তু আমেরিকা-ইউরোপে নতুন করে মন্দার মেঘ জমেছে। ফলে চলতি আর্থিক বছরে ৮ শতাংশ হারে আর্থিক বৃদ্ধি হবে কি না, তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। আজ প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। কিন্তু তাঁর যুক্তি, চলতি মন্দা চিন্তার কারণ হলেও একে স্বল্পমেয়াদি হিসেবেই দেখা উচিত। মুখ্যমন্ত্রীদের আক্রমণের মুখেও আশা ছাড়েননি মনমোহন। তিনি বলেন, “আমরা নেতিবাচক মনোভাবের শিকার হতে পারি বা তার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারি। দু’টোই একই রকম সংক্রামক।” ২০ বছর আগে অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম বাজেট-বক্তৃতায় ভিক্তর উগোকে উদ্ধৃত করে মনমোহন বলেছিলেন, ‘যে নতুন ভাবনার সময় এসে গিয়েছে, তাকে আটকানোর শক্তি পৃথিবীতে কারও নেই।’ ভারতের উত্থানের ভবিষ্যৎবাণীও করেছিলেন তিনি। আজ নিজেই সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, “গত দু’দশকে কেন্দ্রে বা রাজ্যে সব দলের সরকারই একটি সাধারণ পথে হেঁটেছে, আর তাতে আমার ভবিষ্যদ্বাণীই বাস্তব বলে স্বীকৃত হয়েছে।”
আজকের বিরোধিতা সত্ত্বেও আগামী দিনে তারই পুনরাবৃত্তির স্বপ্ন দেখছেন মনমোহন সিংহ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.