কিছু দিন আগে পর্যন্ত নতুন প্রজন্মের লব্জ ছিল, “বাংলা ছবি??? ও মাই গড!!!”
এই মুহূর্তে তারাই বলছে, “বাংলা ছবি! ওয়াও!!!”
এই শুক্রবারে একটা বাংলা ছবি ১০০ দিনে পা রাখছে। আর একটা ছবি চার সপ্তাহে পড়ছে।
প্রথম ছবিটির নাম, ‘ইচ্ছে’। কম বাজেটের ছোট ছবি। বিরাট তারকা, বিরাট প্রচার ছাড়াই রমরমিয়ে ব্যবসা করেছে। এ বছরের অন্যতম বড় হিট। দ্বিতীয়টি ‘বাইশে শ্রাবণ’। এ ছবির ব্যবসা ইতিমধ্যেই দেড় কোটি ছাড়িয়েছে। এবং প্রেক্ষাগৃহে ভিড় এখনও এতটুকু কমেনি।
সংখ্যাতত্ত্ব বাদ দিয়েও বলা যায়, বাংলা ছবি কিন্তু এই মুহূর্তে দু’দু’টো নতুন ঘটনাপ্রবাহের মুখে দাঁড়িয়ে। এক, ‘ইচ্ছে’ এবং ‘বাইশে শ্রাবণে’র মারকাটারি সাফল্যের পর প্রযোজক-পরিচালকরা আরও বেশি করে বুদ্ধিদীপ্ত শহুরে ছবি বানাতে চাইছেন। দুই, গ্রাম আর শহরের দর্শকের মধ্যে ব্যবধান কমে আসছে। তার ফলে ‘বাইশে শ্রাবণ’ বা ‘ইচ্ছে’-র মতো ছবিই হয়ে উঠতে চলেছে বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ। কলকাতার পাশাপাশি শেওড়াফুলি, বোলপুরের মতো জায়গায় যেখানে বাণিজ্যিক ছবিই বেশি চলে, সেখানেও ‘বাইশে শ্রাবণ’ রেকর্ড ভাঙা ব্যবসা করছে। একাধিক প্রেক্ষাগৃহে দর্শক দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিচ্ছেন। পরিচালক-প্রযোজকেরাও কার্যত মেনে নিচ্ছেন, দক্ষিণী ছবি টুকে ‘ঢিসুমঢাসুম-নাচাগানা’ মার্কা ছবির দিন প্রায় শেষ। |
বাইশে শ্রাবণ ছবির একটি দৃশ্যে প্রসেনজিৎ। |
তাহলে কি ছবি হিট করানোর জন্য এ বার ফর্মুলা বদলাতে হবে প্রযোজকদের? টালিগঞ্জের খবর কিন্তু সে রকমই। ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের তরফে মহেন্দ্র সোনি বলছেন, “অটোগ্রাফ একটা ধারা শুরু করেছিল। বাইশে শ্রাবণ সেই ধারাটাকেই প্রতিষ্ঠা দিয়ে দিল।” সুতরাং ভেঙ্কটেশ ফিল্মস যে ভাবে ‘অটোগ্রাফ’ বা ‘বাইশে শ্রাবণ’ প্রযোজনায় এগিয়ে এসেছে, এ বার সেই রাস্তা নেওয়ার কথা ভাবছেন অশোক ধানুকাও। অশোক এত দিন বাণিজ্যিক ছবি ছাড়া অন্য কিছু ভাবেননি। এখন তিনিও বলছেন, “ইচ্ছে আর ‘বাইশে শ্রাবণ’ বাজারের অঙ্কটা বেমালুম বদলে দিয়েছে।”
এই বদলটাই কিন্তু দেখতে চেয়েছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। বললেন, “এই নতুন ধারার ছবিতে কাজ করতে পেরে খুব ভাল লাগছে। ‘অটোগ্রাফে’র সময় শ্রীকান্ত মোহতা আমায় পরিষ্কার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বুম্বাদা, এই ছবিটা আমরা কেন করছি?’ আমি বলেছিলাম, ‘এই ছবিটা করা উচিত শহরের দর্শককে হলে ফেরানোর জন্য।’ আমারও দীর্ঘদিন ধরেই মনে হচ্ছিল, শহরের দর্শক যাঁরা গাড়ি চড়েন, তাঁরা বাংলা ছবি দেখতে আসছেন না। ‘বাইশে শ্রাবণ’ এবং আরও একাধিক শহুরে ছবি সেই দর্শককে হল-এ ফিরিয়ে এনেছে।”
প্রসেনজিতের কথার প্রতিধ্বনি করেই বিজ্ঞাপন জগতের কর্তা শিলু চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “কলকাতায় একটা গোষ্ঠীর বাঙালি আছেন, যাঁদের বলা চলে, ‘মারুতি প্লাস বাঙালি’। এঁরা নিয়মিত দেড় কিলোর ইলিশ কেনেন। যোধপুর পার্কে থাকেন। বিজলীতে ছবি দেখতে চান না। মাল্টিপ্লেক্স বা প্রিয়ায় যেতে পছন্দ করেন। লুচি-ছোলার ডালের সঙ্গে হোয়াইট ওয়াইন খেতে ভালবাসেন। এই অংশটা দীর্ঘদিন বাংলা ছবি থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন। এবং এঁরাই এখন হল-এ ফিরেছেন। এটা খুবই স্বাস্থ্যের লক্ষণ।”
বাণিজ্যিক বাংলা ছবির এ মুহূর্তের সবচেয়ে হিট পরিচালক রাজ চক্রবর্তীও এই পরিবর্তনের কথা স্বীকার করছেন।
নিজে দক্ষিণী ছবির রিমেক করা পরিচালক বলছেন, “ইন্ডাস্ট্রিতে একটা বড় পরিবর্তন হচ্ছে। গত এক বছরে
পাগলু, শত্রু ছাড়া আর কোনও বড় বাণিজ্যিক ছবি হিট করেনি। পাশাপাশি গোরস্থানে সাবধান, মনের মানুষ, অটোগ্রাফ, উড়ো চিঠি, বাই বাই ব্যাঙ্কক, রঞ্জনা আমি আর আসব না, ইতি মৃণালিনী, ইচ্ছে এবং এই মুহূর্তে বাইশে শ্রাবণ পরিষ্কার দেখিয়ে দিয়েছে, দর্শক কেমন ছবি চান। ‘রং মিলান্তি’ও দর্শকের খুবই প্রশংসা পেয়েছে। শুধুমাত্র দুর্বল মার্কেটিংয়ের কারণে ছবিটা তার প্রাপ্য সাফল্য পেল না। ফলে দক্ষিণী ছবির দিন যে ঘনিয়ে এল, সেটা বলাই যায়।” মহেন্দ্র সোনির কথায়, “নাচাগানা ছবিকে এখনই পুরোপুরি বাতিলের খাতায় ফেলছি না। হুগলি, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মেদিনীপুরে এখনও বাণিজ্যিক ছবির দর্শক রয়েছে। তবে হ্যাঁ,
বাইশে শ্রাবণের মতো ছবির সামনে পড়ে ওই সমস্ত ছবির দর্শক ক্রমশ কমছে।”
তার মানে, গ্রাম আর শহরের ব্যবধানও কমছে। সমাজতত্ত্ববিদ আশিস নন্দীর কথায়, “দিল্লি বা গোয়াকে বাদ দিলে গুজরাতের পরই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে নগরায়নের হার সবচেয়ে বেশি। সুতরাং সেই রকম একটা রাজ্যে খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই গ্রাম-শহরের ব্যবধান ক্রমশ ঘুচে যাবে, সেটা অনিবার্য। শহুরে ছবির দর্শক যে বাড়ছে, সেটা এই বৃহৎ সামাজিক পরিবর্তনেরই ফসল।”
একেবারে গোড়ার দিকে যে ক’টি বাংলা ছবি প্রথম মাল্টিপ্লেক্সে মুক্তি পায়, ‘অনুরণন’ তার অন্যতম। আজ বাংলা ছবি সামগ্রিক ভাবে যে সাফল্যের মুখ দেখছে, তা নিয়ে উচ্ছ্বসিত তার পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীও। তিনি বলছেন, ‘‘অনেক দিন ধরে একটা বাজার সুপ্ত অবস্থায় ছিল। যদি ১০০টা লোককে ধরা হয়, তাহলে তার মধ্যে ৩০ জন ‘অনুরণন’ বা ‘বং কানেকশন’ দেখেছিল। ‘অটোগ্রাফ’ বা ‘জাপানিজ ওয়াইফ’ দেখেছিল ৬০ জন। ‘বাইশে শ্রাবণ’ এ বার ১০০ জনকেই হল-এ ফিরিয়ে এনেছে। যে দর্শক এক সময় ভিড় করে ‘সপ্তপদী’ বা ‘আমি সে ও সখা’ দেখতে যেতেন, তাঁরা
আবার বাংলা ছবি দেখছেন। তাতে ছবির মান যেমন বাড়ছে, বাজারও বাড়ছে।” অনিরুদ্ধই ধরিয়ে দিলেন, বাংলা ছবির নতুন দর্শকদের মধ্যে একটা বড় অংশই কিন্তু নতুন প্রজন্ম আর সেটাই সবচেয়ে আশার কথা। ‘ও মাই গড’ থেকে ‘ওয়াও’-এ পরিবর্তনটাই এই মুহূর্তে বাংলা ছবির সবচেয়ে বড় সাফল্য, বললেন তিনি। ‘অনুরণন-বং কানেকশন’ থেকে ‘অটোগ্রাফ-মনের মানুষ’ হয়ে ‘ইচ্ছে-বাইশে শ্রাবণ’, সাফল্য ‘অন্তহীন’.। |