আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মিত্রতা ও শত্রুতার মধ্যে রহিয়াছে অনেকগুলি স্তর। সেই রকম একটি মাঝামাঝি স্তরকে বলা যায় কূটনৈতিক প্রতিযোগিতা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশের সঙ্গে এখন ভারত যে গতিতে বন্ধুতা প্রসার করিতেছে, তাহাতে মনে হয় যে এই সকল নূতন সম্পর্ক-স্থাপনার মাধ্যমে এত দিনে এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তি ভারত ও চিনের মধ্যে সেই কূটনৈতিক প্রতিযোগিতার সম্পর্ক স্থাপিত হইতেছে। ভারত ও চিন সরাসরি মিত্র নহে, শত্রুও নহে। বরং এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে উভয়েরই সমপরিমাণ ভূরাজনৈতিক স্বার্থ লইয়া দুই দেশ পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বীই বলা চলে। তবু এত দিন সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কূটনৈতিক স্তরে সফল ভাবে দৃশ্যমান হয় নাই। চিন যেমন প্রথমাবধি পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে নিজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব খাটাইবার লক্ষ্যে ব্যগ্র প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সহিত উঠিয়া-পড়িয়া লাগাইয়াছিল, ভারত এত দিন কোনও মতেই এই বিষয়ে গা লাগায় নাই। সেই ইন্দিরা-আমল হইতে বিভিন্ন সময়ে ‘লুক ইস্ট’ নীতির ইতস্তত উচ্চারণ সত্ত্বেও মায়ানমার, তাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস প্রভৃতি দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এ যাবৎ ক্ষীণ এবং বিক্ষিপ্ত থাকিয়াছে। বিশেষত বাণিজ্যের ক্ষেত্রটিই যদি ধরা যায়, ভারতের সহিত এই সব দেশের সম্পর্ক যত গভীর ও প্রসারিত হইতে পারিত, তাহা হয় নাই। বহু সময়েই এই অবারিত বাণিজ্য সম্ভাবনায় ভারতের নানা রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হইবার অনিশ্চয়তা এবং আশঙ্কা কূটনৈতিক প্রয়াসকে পিছনে টানিয়া রাখিয়াছে।
উদাহরণস্বরূপ, পাঁচ বৎসর আগে যখন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সহিত মুক্ত বাণিজ্যের প্রস্তাব আনিয়াছিলেন, প্রবল আপত্তি জানাইয়াছিলেন দেশের বাম রাজনীতিক মহল, বিশেষত কেরল প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দ। তাঁহারা ভয় পাইয়াছিলেন যে, কেরলের বাণিজ্য-ফসল-কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক স্বার্থ ইহাতে বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। কিন্তু এই ভয় যে ভিত্তিহীন, অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রী একাধিক বার তাহা ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ভারতের সৌভাগ্য যে অন্যথা-দুর্বলচিত্ত বলিয়া পরিচিত প্রধানমন্ত্রী কিন্তু দেরিতে হইলেও যথেষ্ট দৃঢ়চিত্ততার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত তাঁহার প্রস্তাবকে বাস্তব করিতে অগ্রসর হইলেন। ফলত, গত দুই সপ্তাহে ভিয়েতনাম ও মায়ানমারের শীর্ষনেতারা ভারত সফর করিয়া গেলেন। দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হইল। ভিয়েতনাম ও ভারতের মধ্যে ২০১৫ সালের মধ্যে সাতশো কোটি ডলার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের চুক্তি হইল। কোন কোন খাতে লগ্নি ও প্রযুক্তির আদানপ্রদান হইবে তাহা ক্রমশ স্থিরযোগ্য। মায়ানমারের জন্য নির্ধারিত হইল ভারতের পঞ্চাশ কোটি ডলার উন্নয়ন সহায়তা।
দুই দেশেই চিনের প্রভূত পরিমাণ অর্থলগ্নির কথা সর্বজ্ঞাত। তবে, লগ্নির অঙ্কে চিনের সহিত পাল্লা দেওয়া ভারতের পক্ষে অসম্ভব। অপ্রয়োজনীয়ও বটে। ভারতীয় কূটনীতি মহল নিশ্চয়ই অবহিত যে, এই মাত্রাছাড়া চিনা অন্তঃপ্রবেশের কারণেই আবার দুই দেশে চিনবিরোধী হাওয়াটিও যথেষ্ট জোরদার। ভারতের উচিত, সেই হাওয়াটির সুযোগ লওয়া, চিনের সহিত সম্মুখসমর বা উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার বদলে প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি করিয়া এই প্রতিবেশী-স্থানীয় দেশগুলির সহিত সমমর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা। ভিয়েতনামের সঙ্গে তাহা ইতিমধ্যেই অনেকাংশে সাধিত হইয়াছে। মায়ানমারের সদ্য-নির্মিত অসামরিক সরকারের সহিতও সেই সম্পর্কের সূচনার ইঙ্গিত। প্রেসিডেন্ট থেন সিয়েন-এর নেতৃত্বে নূতন মায়ানমার সরকার এই মুহূর্তে যে মুক্ত ও গণতন্ত্রকামী রাজনীতির পথে অগ্রসর হইতেছে, তাহা অব্যাহত থাকিলে ভারতের পক্ষেও মিত্রভাব বৃদ্ধির সুবিধা হইবে। একটি বিষয়ে সন্দেহ নাই। ভিয়েতনাম বা মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের এই নবকরোজ্জ্বল সম্পর্ক কেবল ভারতের পক্ষেই শুভ নহে, এই সব দেশের পক্ষেও মঙ্গলজনক। চিনের একাধিপত্য হইতে নিজেদের অন্তত অংশত মুক্ত রাখিবার পথ। সেই বাস্তব-বোধ নিশ্চয়ই পূর্ব দিগন্ত হইতে অস্তমিত হইবে না। |