মন্টির সঙ্গে সন্ধি
বাই মিলে হামলে পড়ে ঘিরে ধরল কুট্টিমামুকে। বিকু, টুকাই, মৌমা, ঋজু আর বিন্নি। মুখ গোঁজ করে, গালভরা অভিমান নিয়ে অভিযোগ জানায় ওরা, ‘কুট্টিমামু, তুমি সব সময় মন্টির হয়ে কথা বলো, ওর সব কথায় সাপোর্ট করো কেন?’
কুট্টিমামু হেসে বলে, ‘আরে সব সময় হবে কেন? ও যখন ঠিকঠাক কথা বলে, কাজ করে, শুধু তখনই।’
‘মোটেই না, আমরা দেখেছি, তুমি আমাদেরকে কক্ষনও ভাল বলো না। শুধু মন্টি আর মন্টি। ও যেন তোমার নয়নের মণি। আমরা তোমার কেউ না!’
পাশেই দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে মন্টি। ওর দিকে চোখের একটা ইশারা করে, কুট্টিমামু জোর গলায় বলে ওঠে, ‘ওরে না রে বাবা না। আমি তোদের সব্বাইকে সমান ভালবাসি। যখন যে ঠিকমত কথা শুনে চলে, ভাল করে পড়াশোনা করে, লক্ষ্মী হয়ে থাকে, তখন তার ওপর হয়তো আদরটা একটু বেশি হয়ে যায়। সে মন্টিই হোক বা তোরা যে কেউ।’
কুট্টিমামু যতই স্কুলের স্যরের একটানা বকর বকর করে, পড়া বোঝানোর মতো ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করুক, ওরা মানবে না কিছুতেই। এক কথা ঘ্যানঘ্যান করেই চলল। কুট্টিমামু দেখল অবস্থা বেশ বেগড়বাঁই। এমনটা তো চলতে দেওয়া যায় না। যতই হোক, এরা সবাই ওর খুব আদরের ভাগ্নে-ভাগ্নী, তবে ওদের মধ্যে মন্টির বুদ্ধির ভাণ্ডারটা একটু বেশি। ওর কাণ্ডকারখানা দেখে এক এক সময় তো বড়দেরও তাক লেগে যায়। তাই কুট্টিমামুর আদরটাও অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই পায় ও। তাতেই ওর জুড়িদাররা মাঝে মাঝেই বিদ্রোহ করে। তবে আজকের বিদ্রোহের মাত্রাটা একটু বেশি। কারও চোখ ছলছল, কেউ গাল ফোলা গোবিন্দর মা, কারও ছোট ছোট দাঁতে এমন কিড়মিড় আওয়াজ, যেন ছোলা ভাজা চিবোচ্ছে। ব্যাপারটাকে তো আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। তাই কুট্টিমামু কারও গাল টিপে, কারও চুল ঘেঁটে দিয়ে, কারও পিঠে আলগা চাপড় মেরে বলল, ‘আচ্ছা বেশ, তোদের সবাইকে আমি একটা কাজ দেব, কাজটা এমন ভাবে করতে হবে যে, আমি যেমনটা বলব তেমনটা হবে, আবার মানুষের উপকারেও লাগে।’
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
ওরা হইহই করে উঠল, ‘বলো বলো কী কাজ? আমরা ঠিক মন্টিকে হারিয়ে দেব।’
‘কাজটা কিন্তু সবাইকে আলাদা ভাবে করতে হবে। এমনকী কেউ কারও সঙ্গে পরামর্শ করতেও পারবি না।’ এ কথায় খানিক দমে গেল ওরা। তবু ঘাড় নেড়ে জানাল এই শর্তে সবাই রাজি।
কুট্টিমামু বলল, ‘আমি তোদের সবাইকে দশ টাকা করে দেব। সেই টাকাটা দিয়ে এমন কিছু কিনে আনতে হবে, যাতে এই ঘরের মেঝে, দেওয়াল, ছাদ সব ভরে যায়। পনেরো মিনিট সময় দিলাম। তার মধ্যে যার যা কেনার কিনে আন। তার পর এক এক করে পরীক্ষা হবে।’
কিছুক্ষণের মধ্যে উৎসাহে টগবগ করতে করতে ফিরে এল ওরা। প্রত্যেকের হাতে একটা করে কাগজের প্যাকেট। প্রথমেই ঋজু প্যাকেটের ভেতর থেকে একগাদা কাগজ বার করে কুচি কুচি করে ছড়িয়ে দিল ঘরে। সঙ্গে সঙ্গে বাকিরা সমস্বরে বলে উঠল, ‘এ মা, দেওয়াল-ছাদ তো দূরের কথা। এতে তো মেঝেটাই ভরল না। আর এতে মানুষেরই বা কী উপকার হল, শুনি?’
মৌমা বুদ্ধি করে কিনে এনেছে ক’খানা পেন্সিল। সঙ্গে একটা সার্পনার। আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেন্সিলগুলোকে ছুলে ফেলল চটপট। পেন্সিলের গায়ের রংচঙে জামার মতো ছালটা ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল। ইস্ কী সুন্দর লাগছে। যেন ছোট ছোট রঙিন ফুল। কিন্তু তাতে কী, ঘর তো ভরল না। ফ্যানের বাতাসের ধাক্কায় ঘরের কোণে কোণে জমে রইল ছোট ছোট দলে। এমনি করে বিকু আনল ছোলা ভাজা, টুকাই মুসুর ডাল। আর বিন্নি? সে খুব বুদ্ধি করে এক বালতি জল এনে ঢেলে দিল ঘরের মেঝেতে। সবাই তো রেগেমেগে একসা। বিন্নি চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আমি দশ টাকা বাঁচিয়ে মানুষের উপকার করলাম।’ ঋজু ওর মাথায় চাঁটি মেরে বলল, ‘সেই মানুষটা তো তুই। তোর দশ টাকা লাভ হল। আর বাকি সবার অপকার হল!’
‘কেন?’
‘বাঃ, আমাদের পা ভিজে গেল, জামাটামাও ভিজেছে। এ বারে সর্দি লাগবে নির্ঘাত।’
বিকু বলল, ‘তা ছাড়া দেওয়াল আর ছাদ তো ভরাতে পারলি না।’
বিন্নি রাগ করে বলল, ‘কুট্টিমামু আমাদের সঙ্গে চিটিং করেছে। মাত্র দশ টাকা দিয়ে একটা ঘর ভরার মতো জিনিস কেনা যায় না।’
কুট্টিমামু বলল, ‘মন্টি তো এখনও বাকি আছে। ও-ও যদি না পারে তো, আমি আমার ভুল মেনে নেব।’
ও মা, দেখো কাণ্ড! মন্টি তো ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করছে পটাপট। ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে যেটুকু আলো আসছিল, লম্বা পর্দাগুলো টেনে তা-ও আটকে দিল। বিকু বিজ্ঞের মতো বলল, ‘বুঝলাম, অন্ধকার দিয়ে ঘর ভরলি তুই। এতে তোরও না হয় দশ টাকা বাঁচল। কিন্তু মানুষের কী উপকার হল শুনি?’
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই খুট করে একটা শব্দ। আর সঙ্গে সঙ্গে আলোয় ভরে উঠল গোটা ঘর। ঋজু, টুকাই, মৌমা, বিকু আর বিন্নি অবাক হয়ে দেখছে ঘরের মেঝে, দেওয়াল, এমনকী ছাদও ভরে উঠেছে হাল্কা আলোয়। মন্টির দিকে চোখ ফেরাতেই ওরা দেখল, মন্টির হাতে ছোট্ট একরত্তি টর্চ। সঙ্গে সঙ্গে ওরা বুঝে গেল, মন্টির কাছে হেরেছে সবাই। ঘর তো ভরলই, আলো যে প্রাণীজগতে কত প্রয়োজনীয়, তা তো আলাদা করে বোঝানোর কিছু নেই। ইস্কুলের আর কোচিংয়ের স্যররা এমনকী কুট্টিমামুও হামেশাই বোঝায়। উপকার, প্রয়োজন এ সব তো পরের কথা। আলো না থাকলে নাকি পৃথিবীতে কোনও প্রাণীই জন্মাত না। কুট্টিমামুর ভ্রুতে কিন্তু তখনও ভাঁজ, ‘মন্টি, মাত্র দশ টাকা দিয়ে তুই টর্চটা কিনেছিস বলতে চাস?’ মন্টি বলল, ‘এটা তো নতুন নয়, বাদলকাকুর দোকান থেকে কিনেছি, সেকেন্ড হ্যান্ড। কাজ হওয়া দিয়ে কথা। নতুনই হতে হবে, তা তো তুমি বলোনি।’
‘ওরে ধুরন্ধর’, বলে কুট্টিমামু বাকিদের দিকে তাকাল। ততক্ষণে মুখ কালো করে মন্টিকে ঘিরে ধরেছে ওরা। শুকনো গলায় ঋজু বলল, ‘সত্যি মন্টি, তোর মাথায় এত বুদ্ধি কী করে আসে বল তো?’ মুখ নিচু করে মুচকি মুচকি হাসছে মন্টি। কুট্টিমামুর মুখেও আদরের হাসি। হঠাৎ বিন্নি ডান হাতটা উঁচু করে ধরে বলল, ‘আমি জানি, আমি জানি।’
সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে চাইতে, চোখে-মুখে একটা ভঙ্গি ফুটিয়ে বিন্নি বলল, ‘কারণ, ও হল ধুরন্ধর।’
সবাই বলে উঠল, ‘ঠিক বলেছিস, ঠিক বলেছিস।’
কুট্টিমামু এক লাফে ওদের মাঝখানে চলে এসে মন্টির কাঁধ দুটো ধরে বলল, ‘তা হলে আজ থেকে মন্টির নাম হল...’
সমস্বরে, গলা ফাটিয়ে, হিপ হিপ হুররে বলার কায়দায় ওরা বলে উঠল, ‘ধুরন্ধর মন্টি।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.