স্মরণ ১...
সর্বকালের সেরা
...হাতের কাছে টেলিফোন নম্বরটা ছিল না। জগজিতের চলে যাওয়ার খবর পেয়ে বারবার চোখে ভাসছিল চিত্রার মুখটা। ভাবছিলাম, ফোন করব। ফোন নম্বরটা কারও কাছে পেলাম না।
পরে ভাবলাম, থাক। করে কী হবে? মানুষটাই চলে গেল।
বহু দিন যোগাযোগ ছিল না ওদের দু’জনের সঙ্গে। জগজিৎ মারা যাওয়ার পরে, বেঙ্গালুরুর বাড়িতে টেলিভিশনে ওর গানগুলো শুনছিলাম। মনে হচ্ছিল, কী চমৎকার নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করেছিল গজলে। একই সঙ্গে মাধুর্য ও গভীরতা সে গজলে। গান শুনলেই বোঝা যায়, কী চমৎকার শিক্ষা রয়েছে। জগজিৎ কোন গুরুর কাছে শিখেছিল আমি জানি না। তাঁকে আমার শ্রদ্ধা জানাই।
টিভিতে দেখছিলাম শাবানা আজমির একটা ছবি। সঙ্গে জগজিতের গান। ‘তুম ইতনা জো মুসকারা রহে হো।’ স্বর প্রক্ষেপণ চমৎকার। শুনলেই ভাল লাগা জন্মে যায়। আর একটা গান মনে পড়ছে। সম্ভবত ‘প্রেমগীত’ ছবির। ‘হোঠো সে ছুঁলো তুম’। দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল গান দু’টো। ভাল গান সব সময় জনপ্রিয় হয় না। কিন্তু জগজিতের কৃতিত্ব, ও আমজনতার কাছে দারুণ জনপ্রিয় করে তুলেছিল গজল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ও নিজে সুর করেছে ওর গানগুলোর। তাই কৃতিত্ব আরও বেশি। গানের ভিতরে ঢুকে যেতে পারত। ‘অর্থ’ ছবিতে ‘ঝুকি ঝুকি সি নজর’ গানটা মন দিয়ে শুনলে এটা বোঝা যায়। এমনিতে আমার সবচেয়ে প্রিয় গজল গায়ক মেহদি হাসান। তিনিই এক নম্বর। তার পরেই আসবেন গুলাম আলি। দু’জনের গজল শুনলে অন্য রকম প্রশান্তির সাগরে ডুবে যেতে হয়। গজলকে একেবারে অন্য মাত্রায় নিয়ে চলে গেছেন আমার এই দুই প্রিয় গায়ক।
গজলে এই দু’জনই সর্বোত্তম। দু’জনের দু’রকম স্টাইল। মেহদি হাসান একটা অন্য রকম বিপ্লব এনেছিলেন গজলে সুরের বৈচিত্রে। গুলাম আলি আবার এটাকে অন্য মাত্রা দিয়ে আরও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। মেহদি হাসানের সুরের বৈচিত্র ছিল। গুলাম আলি কথা নিয়ে সুরের খেলা করেছেন অনেক। মেহদিসাহেবের গান বিদগ্ধ শ্রোতারা বেশি পছন্দ করতেন, গুলাম আলি আবার আমজনতার বেশি প্রিয়। আমার সত্তর দশকের অনেক বাংলা গানে এঁদের প্রভাব রয়েছে।
এই দু’জন ছাড়াও পাকিস্তানে এত ভাল ভাল গজল গায়ক-গায়িকা রয়েছেন যে চমকে যেতে হয়। উচ্চারণ হল গজলের অন্যতম শর্ত। আমি বিশ্বের অধিকাংশ দেশে গান করতে গিয়েছি। পাকিস্তানে কোনও দিন যাইনি। কেননা জানি, আমাদের থেকে অনেক ভাল গানবাজনা ও দেশে হয়। পাকিস্তানে এত অনামি গায়কও এত ভাল গান করেন, অবিশ্বাস্য।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতে গজলের জনপ্রিয়তা জগজিৎ অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের সময়ে গজল কিং বলতে একটাই নাম ছিল তালাত মেহমুদ। আমার প্রিয় বন্ধু। অসম্ভব সুরেলা, নম্র গলা। খুব জনপ্রিয় ছিল। গজলঘেঁষা গানের বাইরে সিনেমায় অজস্র জনপ্রিয় গান করেছে তালাত। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ধারণা, ভারতীয় গজলে তালাতকেও ছাপিয়ে গিয়েছে জগজিৎ। তালাতের গজল ছিল জলসাঘরে খোশমেজাজে উপভোগ করার মতো গান। জগজিৎ সেখানে রেওয়াজি, মার্জিত গলায় গজলকে নিয়ে গিয়েছে জলসাঘরের বাইরে। আমজনতার মধ্যে। যেটা ওর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।
ভারতের গজল গায়িকার মধ্যে মধুরানি আমার সবচেয়ে প্রিয়। কী বৈচিত্রময় সুরেলা গলা। বেগম আখতারের গজল মনে রেখেও বলছি, মধুরানি গজলকে একটা পরিচিত বৃত্ত থেকে বের করে এনেছিলেন। ওঁর একটা রেকর্ড, যেখানে দিলীপকুমার ওঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, সেটা একবার শুনে দেখবেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, মধুরানি বেশি গান করতে পারেননি। আড়ালেই থেকে গিয়েছেন। কিন্তু গজলকে পরিচিত বৃত্তের বাইরে আনতে পেরেছেন। পুরুষদের মধ্যে এই কাজ করেছিল জগজিৎ। ও-ই ভারতের সেরা গজল গায়ক। ওকে দেখে অনেকে গজল গাইতে এসেছে। একটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে।

জগজিৎ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঠিক দু’দিন আগে আমরা মির্জা গালিব নিয়ে তৈরি একটা অ্যালবামের গান
বাঁধছিলাম। আমি গালিবের চিঠি পড়ব। ও গাইবে। কী করে জানব সেটাই শেষ দেখা!
জগজিৎকে কাপড়ে-জড়ানো বাক্স-বন্দি দেখে শিউরে উঠেছিলাম। চিত্রা ভাবছিল ও এখনও কোমাতে আছে।
ঠিক হয়ে যাবে। আমার শোকটা এখনও গলায় আটকে আছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে! গুলজার

খুব কমবয়সি ছেলে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার বিশাল ব্যক্তিগত ধাক্কা সামলে জগজিৎ ফিরে এসেছিল গানে। চিত্রাও খুব ভাল গান করত। ও আর সেই শোক সামলাতে পারেনি। চিত্রার গান না গাওয়াটা সঙ্গীতজগতের একটা বড় ধাক্কা বলে মনে করি। জগজিতের গানের মধ্যে শোক ছায়া ফেলেছিল। এতে অন্য রকম মাত্রা পায় গজল। আগের তুলনায় পরের দিকে জগজিৎ নীচের স্কেলে গান করত। কেমন যেন মন্থর। সেটা আমার ব্যক্তিগত ভাবে খুব একটা ভাল লাগেনি। তাতে কিছু এসে যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, লোকে এই স্টাইলটা নিয়েছিল। সব রকমের লোকে ওর গান শুনত। সিনেমার গানের পাশে নন-ফিল্ম গানও। সেটাই তো যে কোনও গায়কের কাছে সবচেয়ে বড় পাওনা।
যত দূর মনে পড়ছে, জয়দেবের সুরে আমি আর জগজিৎ একটা ছবিতে গান করেছিলাম একসঙ্গে। সিনেমাটা চলেনি। গানটাও হিট করেনি। আমার মতো ও-ও অনেক জায়গায় অনুষ্ঠান করেছে।
কিন্তু একসঙ্গে কোনও অনুষ্ঠান করেছি বলে মনে পড়ে না। যাঁরা গজল শুনবেন, তাঁরা আমার গান পছন্দ করেন না। বা, যাঁরা আমার গান শোনেন, তাঁরা আবার গজল পছন্দ করেন না। হয়তো এটাই কারণ। আমেরিকায় একবার একটা শহরে একটা অর্ধে আমি অনুষ্ঠান করেছি, অন্য অর্ধে গুলাম আলি। কিন্তু জগজিতের সঙ্গে গানের অনুষ্ঠান মনে পড়ছে না।
মনে বরং পড়ছে বহু আগের মুম্বইয়ের কিছু ছবি। চিত্রাদের সঙ্গে ওঁর বন্ধু ছিলেন ডক্টর বিশ্বাস। গানপাগল লোক। কোলাবার একটা বাড়িতে আড্ডা ও গান হয়েছে অনেকবার। বাঙালি মেয়ে চিত্রা, তখন ও চিত্রা দত্ত। গজলের পাশে বেশ ভাল বাংলা গানও করত। কিংস সার্কলে আমাদের পাশেই থাকত তালাত। সেখানে মনমোহন কৃষ্ণের আড্ডায় অনেকবার দেখা হত জগজিতের সঙ্গে। তখন লড়াই করছে। চিত্রা আর জগজিৎ তখন থেকেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। নিজেকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে জগজিৎ। তালাত, মেহদি হাসান, গুলাম আলিদের পরিচিত স্টাইল থেকে সরে এসে।
এখানেই মনে হচ্ছে, ভারতের গজলে দুটো ধারার কথা।
তালাত মামুদ একবার আমার বাড়িতে এসেছে। রাতে খেতে বসার আগে ওকে মেহদি হাসানের লং প্লে রেকর্ড চালিয়ে শোনাচ্ছিলাম। কেমন লাগছে? আমি তো মেহদি হাসান বলতে তখন পাগল। তালাত, ভারতের গজল কিং তালাত দেখলাম খুব একটা পছন্দ করছে না। গজলে অত গলার কাজ পছন্দ নয়। আমায় সে দিন একটা দামী কথা বলেছিল তালাত, “গজল গায়ি নেহি যাতি হ্যায়, পড়ি যাতি হ্যায়।”
মানে গজল গাওয়া যায় না, পড়তে হয়। তালাত এই কথাটা মন থেকেই বিশ্বাস করত। আমি আবার সেটা মানতাম না। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, অনেক বিখ্যাত গাইয়ে এই কথাটা বলতেন। উত্তর ভারতের কবিতা পড়া আর বাংলায় কবিতা পড়ার মধ্যে ফারাকটা যাঁরা জানেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন ‘গজল পড়া’ ব্যাপারটা কী। বাংলায় কবিতা আবৃত্তি হয়। হিন্দি বলয়ে কবিতা সুরে বলা হয়। গজল যখন প্রেমের কবিতা, তখন ওখানেও ওই একই ব্যাপার হওয়া উচিত বলে মনে করতেন অনেকে।
আমরা গানবাজনা শুরু করার সময় গজলকে জনপ্রিয় করেছিলেন কে এল সায়গল। অন্য গানের পাশে দারুণ জনপ্রিয় গজল ছিল তাঁর। কিন্তু তিনিও ওই ‘পড়ি যাতি হ্যায়’ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। কালোয়াতি করতেন না গজলে। সহজ সুরে গেয়ে যেতেন গজলের কথা।
আমার মনে হয়, ব্যক্তিগত ভাবে তালাতের ওই স্টাইলটা পছন্দ ছিল। ওই স্টাইলেই নরম, রোমান্টিক গলায় এক দিন সায়গলকে ছাপিয়ে গজল কিং হয়ে উঠেছিল। তালাতের পাশাপাশি গজলে বিখ্যাত ছিলেন জগন্ময় মিত্র মশাই। জগমোহন নামে হিন্দি গীত-গজল করতেন। আমাদের হেমন্তবাবুও অনেক জনপ্রিয় গজল করেছেন। এঁরাও সবাই সায়গল-স্টাইল পছন্দ করতেন। সহজ সুরে গান। দুর্দান্ত কন্ঠ। শচীনদেব বর্মন যেমন আমাদের সুর করাতে বসলে বলতেন, “কালোয়াতি করস না”। তখনকার পুরুষ গায়কদের জনপ্রিয় গজলে রাগাশ্রয়ী মেজাজ বেশি ছিল না।
সীমান্তের ওপারে প্রথমে মেহদি হাসান, পরে গুলাম আলির আবির্ভাব ভারতে গজলের এই পুরনো ভিতটা নাড়িয়ে দিল। তাঁদের গান ভারতে ঢেউ তুলল। সুরের বৈচিত্রে এলোমেলো করে দিল গজলের জগৎ। জগজিৎ এঁদেরই অনুসারী। দ্বিতীয় ধারার গায়ক। সুর ছিল ওঁর অস্ত্র। গজল কোনও দিন ও পড়তে যায়নি, গাইতেই গিয়েছে। রেওয়াজি গলায়। মেহদিসাব বা গুলাম আলি সাবের দেখানো পথে এগিয়ে অন্য রাস্তা তৈরি করে নিয়েছে। একেবারে নিজের রাস্তা। সাধারণ মানুষকে সঙ্গী করে। ওর যা দুর্দান্ত শিক্ষা, ইচ্ছে করলে গানে কালোয়াতি আনতে পারত। কিন্তু চেষ্টা করেনি। তাতে ওর গজল অন্য ঐশ্বর্যের সন্ধান দিয়েছে।
যত দিন এই উপমহাদেশে গজল থাকবে, তত দিন জগজিৎ বেঁচে থাকবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.