নিরাপত্তায় ঝুঁকি নিচ্ছে না পুলিশ |
ভয় নয়, জঙ্গলমহল পৌঁছে বার্তা মমতার |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
রাস্তার ধারে কাতারে কাতারে মানুষ। করতালি দিচ্ছেন। সেই অভিবাদন মাথায় নিয়েই শুক্রবার রাত ন’টায় জঙ্গলমহলের জেলাসদর মেদিনীপুরে পৌঁছলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসায় আপ্লুত এবং প্রবল আত্মবিশ্বাসী মুখ্যমন্ত্রী এর পর পুলিশকর্তাদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে মাওবাদীদের হুমকি, ভয় দেখানোকে অবজ্ঞা করারই পরামর্শ দিলেন। ঠিক যেমনটা তিনিই নিজেই করে আসছেন।
ধর্মা থেকেই রাস্তার দু’ধারে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল জনতা। কনভয়ে তাঁর গাড়ির দেখা মিলতেই শুরু হল ‘দিদি’র জয়ধ্বনি। সমবেত করতালির সঙ্গেই ভেসে এল জনতার বার্তা: ‘দিদি, আমরা আপনার সঙ্গেই আছি’। সেই বার্তা পড়ার ক্ষমতার জোরেই যিনি বাংলার জননেত্রী, সেই মমতার মনে যদিবা জঙ্গলমহল নিয়ে চিন্তা-উদ্বেগ কিছু থেকে থাকেজনতার বিপুল অভ্যর্থনার পর তিনি নিশ্চিন্ত। মানুষ যেখানে তাঁর সঙ্গেই কেনই বা
গুরুত্ব দেবেন মাওবাদীদের! মেদিনীপুর রেঞ্জের ডিআইজি বিনীত গোয়েল, পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠিকেও তাই মাওবাদীদের অগ্রাহ্য করা কথাই যে তিনি বলবেন, স্বাভাবিক। আর তার মধ্যে দিয়েই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁর এই দ্বিতীয় বারের জঙ্গলমহল সফরের ‘সুর’ও বেঁধে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
|
মেদিনীপুর সার্কিট হাউসে ঢুকছেন মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার রাতে। ছবি: সুদীপ আচার্য |
মুখে আলোচনার কথা বললেও ক’দিন আগে বাবু বসুর মতো জনপ্রিয় ঝাড়খণ্ডী নেতাকে খুনের ঘটনা থেকে বৃহস্পতিবার সর্ডিহায় রেললাইনে কৌটো রেখে মাইন-আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা---মাওবাদীদের কার্যকলাপে সরকার বিরক্ত। জঙ্গলমহলে ‘শান্তি’ স্থাপন নিয়ে চিন্তাও রয়েছে। সেই চিন্তা-বিরক্তির পাশ কাটিয়েই শুক্রবার রাত থেকে শুরু হল মুখ্যমন্ত্রীর ‘মিশন জঙ্গলমহল’। আজ, শনিবারই তাঁর সভা জঙ্গলমহলের প্রাণকেন্দ্র ঝাড়গ্রামে।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনের তরফে কোনও ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে না। বাড়তে থাকা মাওবাদী সক্রিয়তার প্রেক্ষিতে জঙ্গলমহল জুড়েই নিরাপত্তা ঢেলে সাজা হয়েছে। শুক্রবার থেকেই ঝাড়গ্রাম ও তার আশপাশে শুরু হয়েছে জোর তল্লাশি। যে সব রাস্তা দিয়ে মেদিনীপুর থেকে ঝাড়গ্রামে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর, সে পথেও কড়া নজরদারির ব্যবস্থা হয়েছে। রাস্তার দু’ধারে মাইন ডিটেক্টর দিয়ে দিনভর তল্লাশি চলেছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠি জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সফর ঘিরে নিরাপত্তার সব আয়োজনই সম্পূর্ণ।
ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে সভা করবেন মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার স্টেডিয়াম পরিদর্শন করেন ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার গৌরব শর্মা-সহ অন্য পুলিশ আধিকারিকেরা। সভাস্থলে ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা পুলিশ। স্টেডিয়াম চত্বরে ইতিমধ্যেই সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সে জন্য বাইরের জেলা থেকেও পুলিশকর্মীদের আনা হয়েছে। মাঠের ধারে বাঁশের ব্যারিকেডও তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে গোয়েন্দা দফতরের একটি দলও ঝাড়গ্রামে পৌঁছেছে। তারা নিরাপত্তার সব দিক খতিয়ে দেখছে। সভাস্থল ও সংলগ্ন এলাকায় সাদা পোশাকের পুলিশও থাকছে। ঝাড়গ্রাম সংলগ্ন গ্রামগুলোতেও নজরদারি শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। |
নজরবন্দি... |
|
ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে আজ সভা করবেন মুখ্যমন্ত্রী। কড়া নিরাপত্তায় চলছে
শিলান্যাসের ফলক বসানোর প্রস্তুতি। ছবি: দেবরাজ ঘোষ |
আজ, শনিবার সকাল দশটায় প্রথমে মেদিনীপুর সার্কিট-হাউসে প্রশাসনিক বৈঠক করবেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকে জেলাশাসক এবং জঙ্গলমহলের বিডিও-রা উপস্থিত থাকবেন। বেলা একটা নাগাদ ঝাড়গ্রামের উদ্দেশে রওনা হবেন মমতা। সেখানে বেলা দু’টোয় তাঁর সভা। সরকারি এই সভায় উপস্থিত থাকবেন মুখ্যসচিব সমর ঘোষ, স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতম, পূতর্সচিব অজিতরঞ্জন বর্ধন, স্কুলশিক্ষা সচিব বিক্রম সেন প্রমুখও। ঝাড়গ্রামের সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রীর একাধিক প্রকল্প ঘোষণা করার কথা। এর মধ্যে রয়েছে নয়াগ্রামে একটি সেতু। এটি তৈরি করবে পূর্ত দফতর। ১৭টি মাধ্যমিক স্কুলকে উন্নীত করার ঘোষণা হওয়ারও কথা। ঝাড়গ্রাম মহকুমা হাসপাতালকে জেলা হাসপাতালে উন্নীত করার প্রকল্পের শিলান্যাস হতে পারে।
মেদিনীপুর থেকে ঝাড়গ্রাম পৌঁছনোর দু’টি রাস্তা রয়েছে। এক, শহর থেকে বেরিয়ে খড়্গপুরের চৌরঙ্গি। সেখান থেকে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে লোধাশুলি হয়ে ঝাড়গ্রাম। দুই, মেদিনীপুর থেকে ধেড়ুয়া হয়ে ঝাড়গ্রাম। দু’টি পথেই নিরাপত্তা সমান জোরদার করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কোন পথে মুখ্যমন্ত্রী ঝাড়গ্রামে পৌঁছবেনতা অবশ্য নিরাপত্তার কারণেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে না। মেদিনীপুর থেকে লালগড় যাওয়ার রাস্তার খানাখন্দও তড়িঘড়ি সংস্কার করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, কোনও কর্মসূচি না-থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী যদি লালগড় যেতে চান, সে জন্যই এই রাস্তা তড়িঘড়ি সংস্কার করা হয়েছে। |
|
শুক্রবার রাতে শহরে পৌঁছেই চেনা মেজাজে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
এ দিকে, মুখ্যমন্ত্রীর সফরের ঠিক মুখে বিনপুরের আঁধারিয়া এলাকায় তাঁর দলেরই ৫ কর্মী পোস্টার দিয়ে দল ছাড়ার ঘোষণা করায় শোরগোল পড়েছে। এক সময়ে এ সব অঞ্চলে মাওবাদী হুমকিতে একের পর এক সিপিএম নেতা-কর্মী ঠিক এ ভাবেই পোস্টার দিয়ে দল ছাড়ার ঘোষণা করতেন। তৃণমূল সরকারে এসেছে পাঁচ মাসও হয়নিএরই মধ্যে নতুন শাসকদলের নেতা-কর্মীদের একই কারণে পোস্টার সাঁটাতে হল কি নাসে প্রশ্ন উঠেছে। বিড়ম্বনা বেড়েছে তৃণমূল জেলা নেতৃত্বের। দলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়ের বক্তব্য, “বিষয়টি নিয়ে পুলিশ-প্রশাসন খোঁজখবর নিচ্ছে। আমরাও দলীয়স্তরে খোঁজ নিচ্ছি। আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য ভয় দেখিয়ে কেউ এ কাজ করিয়ে থাকতে পারে।” |
|
তার আগে সকালে মেদিনীপুরের প্রবেশপথ, ধর্মায় পুলিশি টহল। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
পোস্টারে দলত্যাগী তৃণমূল কর্মী বিজয়কৃষ্ণ বাউল, নরসিংহ রথ, শেখ ইনসান আলি, বাবলু কারক ও শেখ জাকিরদের অবশ্য বক্তব্য, ‘স্বেচ্ছায় তৃণমূল ছাড়ছি। অন্য কর্মীদেরও আমরা দলছাড়ার আহ্বান জানাচ্ছি। নির্বাচনের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এসে তা রাখছেন না। উল্টে সন্ত্রাস হচ্ছে। যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার ও বন্দিমুক্তি না-হওয়ায় দল জন-বিচ্ছিন্ন হচ্ছে’। যদিও পুলিশের অনুমান, মাওবাদীদের হুমকির জেরেই পোস্টারের এমন বয়ান। জেলা পুলিশের এক আধিকারিকের বক্তব্য, “শুধু বিনপুরই নয়, নয়াগ্রাম, লালগড়-সহ আরও কয়েকটি এলাকায় মাওবাদীরা প্রভাব বাড়াতে শুরু করেছে। স্থানীয়দের নানা ভাবে ভয় দেখাচ্ছে বলেও আমাদের কাছে খবর রয়েছে।” এ দিনই পুরুলিয়ার বলরামপুরে অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে বেশ কয়েকটি গ্রামেও ফের মাওবাদী-পোস্টার নজরে আসে। পোস্টারে শান্তি-উন্নয়নের দাবি তুলে সরকারের সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হলেও পুরুলিয়া পুলিশ-প্রশাসনের উদ্বেগ বেড়েছে ফের এই মাওবাদী সক্রিয়তায়। |
|
মুখ্যমন্ত্রী আসার আগে শহরে চলছে হাম্প কাটা। |
অন্য দিকে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে জেলাশাসকের কাছে আবেদন করেছিল ‘সন্ত্রাস দুর্নীতি ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন-বিরোধী গণতান্ত্রিক মঞ্চ’। এই মঞ্চের হয়েই বিধানসভায় ভোটপ্রার্থী হয়েছিলেন জনগণের কমিটির জেলবন্দি নেতা ছত্রধর মাহাতো। জেলাশাসকের দফতর থেকে তাদের শুক্রবারই জানানো হয়েছে, আবেদন মঞ্জুর করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত জেনে মঞ্চের সম্পাদক অশোক জীবনের প্রতিক্রিয়া, “জঙ্গলমহলে শান্তি স্থাপনের চাবিকাঠি মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই রয়েছে। তাই দেখা করতে চেয়েছিলাম। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের মিথ্যে মামলায় জেলে ভরে, সালওয়া জুড়ুম তৈরি করে কিন্তু শান্তি ফিরবে না। মিথ্যে মামলায় গ্রেফতার হওয়া মানুষকে মুক্তি দেওয়া হোক। যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার করা হোক। আলোচনা হোক সর্বস্তরে।” |
|