উত্তর কলকাতা
সুরাহা কবে
ফলভোগের পট্টি
বালমুকুন্দ মক্কর রোড, রামলোচন মল্লিক স্ট্রিট, বর্মণ স্ট্রিট, মদনমোহন বর্মণ স্ট্রিট, সৈয়দ সালি লেন— কলকাতার প্রাণকেন্দ্রের কয়েকটি রাস্তা। ঠিকানার সন্ধানে কোনও আগন্তুক এখানে এসে নিশ্চিত চক্কর খাবেন। রাস্তা জুড়ে দাঁড় করানো ছোট-বড় ট্রাক, টেম্পো। অনবরত ট্রাক থেকে মুটের ঝাঁকায় অথবা দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি সাইকেল ভ্যানে বোঝাই হচ্ছে ফল। অন্য দিকে ট্রাকের সামনে ফলের স্তূপ পাল্লা মেপে হাত বদল হয়ে যাচ্ছে। কোথাও রাস্তা ছাড়িয়ে খানিকটা ফুটপাথে উঠে এসেছে ট্রাকের চাকা। পচা-থেৎলানো ফল আর বর্ষার দিনে জলে-কাদায় ঢেকে যায় রাস্তা। কলকাতার সবচেয়ে বড় পাইকারি ফলবাজার মেছুয়া-র ছবিটা এমনই।
কলকাতা পুরসভার ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত এই এলাকা। ওয়ার্ড ঘেঁষে চলে গিয়েছে রবীন্দ্র সরণি, মহাত্মা গাঁধী রোড আর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। জোড়াসাঁকো থানার অধীন এই এলাকা। এলাকার চার দিকে ঘন জনবসতি। বহুতল পাকা বাড়ির এক একটিতে অসংখ্য পরিবার। আশপাশে কয়েকটি স্কুলও আছে। স্কুলের ফটকের দু’পাশে অনবরত গাড়ি পার্ক করে মালপত্র ওঠানো-নামানো চলে। বাড়ির সদর আগলে বসে ফলের দোকান।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, ৪ নম্বর বল্লভ দাস স্ট্রিট ও ১২ নম্বর রামলোচন মল্লিক স্ট্রিটের বাড়ি-সহ কয়েক’টি বাড়ির একতলা ‘ফলের অকশন’ এলাকা বলে চিহ্নিত। বাকি রাস্তা আর ফুটপাথ সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে দখল করে ব্যবসা চলছে। বাসিন্দা রাজেশকুমার জৈন বলেন, “জীবনযাত্রার স্বাভাবিক ছন্দটাই এখানে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সুস্থ ভাবে বেড়ে ওঠার কোনও পরিবেশ নেই। যাঁদের উপায় নেই তাঁরা থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। বহু পুরনো বাসিন্দা গত ৮-১০ বছরে এলাকা ছেড়েছেন।” মদনমোহন বর্মণ স্ট্রিটের বাসিন্দা সাবির আলির বক্তব্য, “স্কুল যাতায়াতে বাচ্চাদের খুব কষ্ট হয়। ধাক্কাধাক্কি আর কটূক্তির ভয়ে বাড়ির মেয়ে-বউরাও চলাফেরা করতে পারেন না। কোনও আত্মীয় আসতে চান না। ভোর তিনটে থেকে শুরু হয় হইচই। বিকেলেও নিস্তার নেই।”
বাসিন্দাদের দাবি, জোড়াসাঁকো থানায় বহু বার অভিযোগ জানানো হয়েছে। লালবাজারেও অভিযোগ জানানো হয়েছে। স্থানীয় কাউন্সিলর থেকে মন্ত্রী সর্বস্তরে লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ট্রাফিক আইন ভেঙে দিনের ব্যস্ত সময়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে বড় লরি এলাকায় ঢুকছে বাধাহীন ভাবে। অথচ, কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
প্রশাসন ও ব্যবসায়ী মহল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সত্তরের দশকে শুরু হয়েছিল রাস্তার বাজার। মদনমোহন বর্মণ স্ট্রিটের এক দিকের বাজারটির বয়স ৫-৬ বছর। ক্রমশ ঘন হচ্ছে সেটিও। প্রায় ১০০ জন পাইকারি, ৫০০ জন ‘ফড়িয়া’ অর্থাৎ আধা পাইকারি এবং দু’হাজারের মতো খুচরো ব্যবসায়ীর দখলে ফল বাজার। নিজস্ব নিয়মে চলা এই বাজারে এক ফালি ঘর চার-পাঁচ মাসের লিজে পঞ্চাশ হাজার টাকার অলিখিত ভাড়ায় মেলে। দোকান আগলে ট্রাকের মাল ওঠানো-নামানোর জন্য দিতে হয় নির্দিষ্ট খেসারত। ফল-ব্যবসার সঙ্গে জুড়ে আছে পেটি তৈরির ব্যবসা, প্যাকিংয়ের ব্যবসা, হাজার কয়েক মালবাহকের রোজগার।
অথচ কাঠ, প্লাস্টিক, ফল পাকানোর জন্য ব্যবহৃত কার্বাইড স্লেটে বোঝাই এই জতুগৃহে কোনও রকম অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। মদনমোহন বর্মণ স্ট্রিটের এক বাসিন্দা জানান, কয়েক বছর আগে দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ এক জনকে এখান থেকে মাথার ঝাঁকায় বসিয়ে বের করতে হয়েছিল। তাঁর আশঙ্কা, কোনও দিন আগুন লাগলে সব শেষ হয়ে যাবে। দমকল, অ্যাম্বুল্যান্স ঢোকার রাস্তা পাবে না।
মানুষের দৈনন্দিন জীবন আটকে কেন এ ভাবে ব্যবসা চালাচ্ছেন? দ্য ক্যালকাটা ফ্রুট মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি মহম্মদ শোহরাব বলছেন, “সুষ্ঠু ভাবে ব্যবসা চলে। বাসিন্দাদের কোনও সমস্যাই হয় না। বাসিন্দাদের বেশির ভাগই ফল-ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকায় ওঁরা এ সবে অভ্যস্ত।” অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা প্রসঙ্গে তাঁর দাবি, “এমন পরিস্থিতি যাতে না হয় তার জন্য প্রত্যেকে সচেতন। যদি হয় নিমেষে কয়েক হাজার লোক হাত লাগিয়ে খালি করে দেবে মন্ডি।” ফড়িয়া কমিটির ট্রেজারার মহম্মদ মুসলিম অবশ্য স্বীকার করে নিচ্ছেন বাসিন্দাদের দুর্ভোগের কথা। তাঁর বক্তব্য, “এ ব্যাপারে আমি কিছু করতে পারব না। ব্যবসায়ীদের মিটিং ডেকে রাস্তায় না-বসার অনুরোধ করতে পারি শুধু।”
৪১ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর রীতা চৌধুরী বলেন, “বছর কয়েক আগে সরকারি স্তরে চেষ্টা হয়েছিল কলকাতার বাইরে ফলপট্টি স্থানান্তরের। অজানা কারণে ও আন্তরিকতার অভাবে তা বাস্তবায়িত হয়নি।” তাঁর কথায়: “বছরের পর বছর পুরসভা এবং সরকারি স্তরে কোনও রকম কর না দিয়ে ব্যবসা চলছে। সরকার নিরুত্তাপ। আমি ব্যক্তিগত ভাবে চেষ্টা করেছিলাম। ব্যবসায়ীদের কাছে হেনস্থা হয়ে পিছিয়ে যাই। তবু এর উন্নতির জন্য তৎকালীন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যকে লিখিত আবেদন জানাই। উত্তর পাইনি। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকেও জানিয়েছিলাম, সাড়া মেলেনি। আবর্জনা সাফাই করাটা এখানে দুর্বিষহ। রবিবার অর্ধেক পট্টি বন্ধ থাকায় ওই দিন সাফাইয়ের কাজ ভাল ভাবে হয়। তবু সার্বিক ভাবে হয়ে ওঠে না। বাসিন্দাদের সমস্যা নিজের চোখে দেখেও নিরুপায় অবস্থা।”
কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (নিকাশি ও পার্কিং) রাজীব দেব বলেন, “ফলপট্টিতে পার্কিংয়ের দায়িত্ব ওখানকার ব্যবসায়ীদেরই। তাঁদেরই জায়গাটি পরিষ্কার করার কথা। কারণ, ওখানে বিভিন্ন সময়ে ফলের গাড়ি ঢোকে ও বিভিন্ন সময়ে পাতা ও অন্যান্য আবর্জনা পড়ে। ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্যই পার্কিংয়ের দায়িত্ব তাঁদের দেওয়া হয়েছে। তবে, গোটা বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব পুরসভার পার্কিং বিভাগের। ওখানে পার্কিং এবং জঞ্জাল পরিষ্কার ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা দেখতে আমরা শীঘ্রই বৈঠকে বসব।”
কলকাতা পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রাত্রি দশটা থেকে ভোর ছ’টা পর্যন্ত সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে ভারী গাড়ি যাতায়াত করতে পারে। এই নিয়ম না মানা হলে সেটা কেন হচ্ছে না খোঁজ নেব। বালমুকুন্দ মক্কর রোড বা মদনমোহন বর্মণ স্ট্রিটের ক্ষেত্রে ট্রাফিকের নির্দিষ্ট কী নিয়ম আছে তা দেখতে হবে। স্কুলের সামনে বা বাড়ির সদর আটকে যে কোনও পার্কিংই অবৈধ। এ সব ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশ নিয়মিত কেস দেয়। রাস্তা জুড়ে মাল ওঠানো-নামানোয় সাধারণ মানুষের সমস্যা হলে কলকাতা পুলিশের দায়িত্ব তা নিয়ন্ত্রণ করার। সেটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না অবশ্যই দেখতে হবে।” স্থানীয় থানার অসহযোগিতার অভিযোগ প্রসঙ্গে ডিসি ট্রাফিক বললেন, “নির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে বাসিন্দারা ডিসি সেন্ট্রালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন। তাঁদের অভিযোগ যথাযোগ্য ভাবে বিবেচনা করা হবে।”



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.