|
|
|
|
ধোনিদের স্পিন মন্ত্রে তছনছ কুকদের অহঙ্কার |
সব্যসাচী সরকার • হায়দরাবাদ |
যাঁরা টিভিতে ম্যাচটা টাটকা দেখলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, যে চ্যানেলে এই সিরিজ সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে, তার কেষ্টবিষ্টুরা ভেবেচিন্তে একটা স্লোগান বার করেছেন। দেখানো হচ্ছে খেলার আগে এবং একটু বিজ্ঞাপনের ফাঁক পেলেই। ‘দেখ লেগা ইন্ডিয়া!’ আপাত জৌলুসহীন সিরিজের টিআরপি বাড়াতে যেমন আকছার হয়ে থাকে। প্রথম ম্যাচেই এ ভাবে খাপে খাপে মিলে যাবে ‘দেখে নেওয়া’-র থিমটা, এ নিশ্চয়ই স্লোগানের স্রষ্টাও ভাবেননি। কিন্তু ভারত ‘দেখে’ তো নিল! মিলে তো গেল! ‘পেস আর সুইং খেলতে পারিনি বলে তো খুব হেসেছিলি, তা তোদেরও তো স্পিনে ‘বোমকে বাইশ’ অবস্থা....’ কুকদের এমন টিটকিরি ধোনিবাহিনীর কেউ দেয়নি। দেওয়ার প্রশ্নই নেই। তবে সব কী আর মুখে বলতে হয়? শরীরেরও তো একটা ভাষা থাকে। আর ইংল্যান্ডকে ১৭৪-এ মুড়িয়ে দিয়ে যে হাসিটা মুখে ঝুলিয়ে ড্রেসিংরুমে হাঁটা দিলেন রায়না-কোহলি-প্রবীণরা, তার একটাই মানে হয়। দ্যাখ কেমন লাগে!
কেমন আর লাগবে! যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হলে যেমন লাগে! ভারতে সফরকারী বিদেশি দলগুলোর বাসরঘরে চিরকাল যে ছিদ্র দিয়ে কালসাপ ঢুকে এসেছে, ঢুকল সেখান দিয়েই। স্পিনে চূড়ান্ত বেসামাল অতিথি টিম। ক্লাস থ্রি-র ছাত্রকে আইনস্টাইনের থিয়োরি অব রিলেটিভিটির ক্লাসে বসিয়ে দিলে যেমন হয়, ততটাই যেন ল্যাজেগোবরে অশ্বিন-জাডেজার স্পিনে। ইংল্যান্ড যখন ১৩৪-৭, গ্যালরিতে ব্যানার উঠল, ‘ইটস পে ব্যাক টাইম’! কড়ায়-গণ্ডায় ধার শোধ করার সময়। সম্মান নিয়েছিলি, এবার ফিরিয়ে দিয়ে যা! সিরিজের এখনও ঢের বাকি। তবে সকাল যদি বাকি দিনটার ইঙ্গিতবাহী হয়, ইংল্যান্ডের সামনে এখন কঠিন চড়াই। আর ধোনির ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা’ ব্রিগেডের সামনে চ্যালেঞ্জ প্রমাণ করার এই জয় ‘ফ্লুক’ নয়। আসলে ইংল্যান্ড ইংল্যান্ডে সুন্দর, ভারত ভারতে!
|
|
মারমুখী ধোনি। শুক্রবার। ছবি: এপি |
আনকোরা বোলিং লাইনআপের রবিচন্দ্রন অশ্বিন ক্যাপ্টেনের আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল, সবাই জানত। হরভজনহীন স্পিন আক্রমণের ব্যাটন তরুণ অফস্পিনার তুলে নিতে পারেন কি না, সেই কৌতূহল এই সিরিজের অন্যতম ক্রিকেটীয় প্রাণভোমরা, সেটাও জানত। ফার্স্টপেপারে লেটার মার্কস নিয়ে উত্তীর্ণ সৌম্যকান্তি অশ্বিন ফ্লাইট করিয়েছেন অকুতোভয়ে। স্টক অফস্পিনের সঙ্গে আয়েশে মিশিয়ে দিয়েছেন ক্যারম বল, ব্যাটসম্যানকে সব সময় ফ্রন্টফুট-না-ব্যাকফুট দোনামোনায় রেখেছেন। যা মনে হচ্ছে, ভাজ্জির ‘বনবাস’-এর মেয়াদ বোধহয় বাড়ল। দোসর রবীন্দ্র জাডেজা আহামরি কিছু বল করেননি কিন্তু। হাল্কা ফ্লাইটে জায়গায় রেখেছেন মাত্র। তাতেই বিপক্ষ শুয়ে পড়েছে। দু’জনে মিলিয়ে ১৫.১ ওভারে ৬৯ রান দিয়ে ছ’উইকেট।
উপমহাদেশের মার্কামারা ব্যাটিং উইকেটের থেকে উপ্পলের উইকেট আলাদা কিছু নয়। একটু ঢিমে তালের। বল থমকে ক্রিজ অবধি পৌঁছচ্ছে। এই পিচে রানের মাল্টিস্টোরিড না হোক, তিনতলা বাড়ি হাঁকানোই যায়। সোয়া তিনশো হেসেখেলে না হোক, এখানে ২৭৫ খুব দূরের স্টেশন নয়। ভারতের গাড়ি প্ল্যাটফর্মে থেমেছিল বাড়তি ২৫ নিয়ে। পুরো তিনশো। সেটা তাড়া করা দূরঅস্ত, সম্মানজনক লড়াইও দেখল না উপ্পল।
ভারতীয় ব্যাটিংয়ে আসি। একটা সময় মনে হচ্ছিল আড়াইশো ছাড়ালে হয়, টস জেতার সুবিধেটা না মাঠে মারা যায়। যে ভাবে প্রথম পাঁচ ওভারের চোখরাঙানি শুরু করেছিল ভাগ্য! পার্থিব মেজাজে শুরু করেছিলেন, জমিয়ে বসার আগেই রান আউট। রাহানের স্ট্রেট ড্রাইভ বোলারের হাত ছুঁয়ে উইকেটে। আরও বড় দুর্ভাগ্য অবশ্য ০ রানে স্লিপে রাহানের ক্যাচ পড়া। আউটটা হলে শুরুর পাওয়ার প্লে-র ওভারগুলো এমন নিষ্ফলা যেত না। রাহানে থাকলেন এবং প্রথম দশটা ওভারের ৬০টা বলের ৩৩টা একাই খেলে রান করলেন ১৩। পিচ অনুযায়ী ব্যাটিংয়ের ছাঁচ বদলানোর তো একটা ব্যাপার থাকে। যেটা রাহানে বুঝে ওঠার আগেই দুর্মূল্য ওভারগুলো বেমালুম খরচ। উল্টো দিকে গম্ভীর রান পাচ্ছিলেন অনায়াস ছন্দে। ক্রিজে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে, বলকে ব্যাটের কাছে নেমন্তন্ন করে। আশ্চর্য লাগল, আনকোরা নতুন সঙ্গী রাহানে পিচকে ভুল বুঝে আটকে যাচ্ছেন দেখেও ভুল ধরিয়ে দিলেন না গম্ভীর। জুনিয়রকে ঠিকঠাক ‘গাইড’ করাটাও তো সিনিয়রের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে! |
|
স্বস্তিতে ফেরা। ইংল্যান্ডকে হারানোর পর অধিনায়কের
সঙ্গে ভারতের তরুণ ব্রিগেড। ছবি: উৎপল সরকার |
সিনিয়রই বা প্রত্যাশিত পরিণতি দেখালেন কোথায়? ডার্নবাখ নিয়ম করে প্রতি ওভারে একটা করে স্লোয়ার দিচ্ছিলেন। আর সেট হয়ে যাওয়ার পরেও এরকম একটা স্লোয়ার ফুলটসেই সুইপ করতে গিয়েই গম্ভীর লেগবিফোর। যাঁর ইনিংসটা টানার কথা ছিল। টানলেন রায়না আর তার চেয়েও বেশি করে ধোনি। ৩৫ ওভারে বোর্ডে যখন ১৫০-৪, দূরতম কল্পনাতেও ভাবা যায়নি, শেষ ১৬ ওভারে ধুন্ধুমার ১৫০ উঠবে। ৩৬তম ওভারে ব্যাটিং পাওয়ার প্লে নিলেন ধোনি আর ঝটিতি কেউ যেন রানরেটে ফাস্ট ফরোয়ার্ড বোতাম টিপে দিল। শুরু রায়নার আতসবাজি দিয়ে। বিশ্বক্রিকেটে এখন দু’জন সুরেশ রায়না খেলেন। লোক একই, সত্ত্বা আলাদা। ডক্টর জেকিল আর মিস্টার হাইডের মতো। একজনের টেকনিকে বিস্তর ফাঁকফোকর ধরা পড়ে যায় টেস্ট ক্রিকেটে। এক দিনের ম্যাচে সেই লোকেরই বরাবর অন্য মূর্তি। যেন স্ট্রোকের মণিহারি দোকান। আর ধোনির ৭০ বলে ৮৭ নট আউট নিয়ে কোনও কথা হবে না। এলেন মাঝামাঝি, থাকলেন শেষ বল পর্যন্ত। আর কী প্রচণ্ড সেই থাকা। যন্ত্রের শক্তির একক হিসেবে ‘হর্সপাওয়ার’ শব্দটা ব্যবহার হয়। ব্যাটসম্যানের শটের শক্তির একক হওয়া উচিত ‘এমএসডি’। উচ্চারণ করার সময় পাবেন না ‘ধোনি’ শব্দটা, তার আগেই বল ক্ষেপণাস্ত্রের গতিতে বাইরে। বিখ্যাত হেলিকপ্টার শটে ছয় তো ছিলই, সঙ্গে মাঠের চারদিকে ধূমধাড়াক্কা বাউন্ডারি। ইংল্যান্ড সফরে ওয়ান ডে সিরিজে গড় ছিল ৮০-র কাছাকাছি, এখানে শুরুটা আরও জবরদস্ত। একেবারে ধোনিসুলভ। শিল্প নেই, শক্তি আছে। বাহার নেই, বাহাদুরি আছে। সূক্ষ্মতা নেই, শৌর্য আছে। |
|
ধোনিদের ম্যাচ দেখতে বাড়ির বাইরে সানিয়া মির্জা।
অস্ত্রোপচারের পর এই প্রথম। ছবি: উৎপল সরকার |
মারের চোটে শেষ দিকে কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলল ইংরেজরা। শুরুতে বোলিংয়ে যে শৃঙ্খলা ছিল, রাতারাতি ভ্যানিশ। একটা ব্যাখ্যা বোলারদের অনভিজ্ঞতা। মার শুরু হতেই লাইন-লেংথ সব তালগোল পাকিয়ে গেল ফিন-ডার্নবাখ-ব্রেসনানদের। যাঁদের বুঝতে সময় লাগবে এটা ট্রেন্টব্রিজ বা ম্যাঞ্চেস্টার নয়। এখানে উইকেট টু উইকেট বল করে ব্যাটসম্যানের ভুলের জন্য অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। তাই ইয়র্কার করতে গিয়ে ফুলটস, সুইং করতে গিয়ে এন্তার ওয়াইড। দুই, কুকের বিশ্রী আর দিশেহারা ক্যাপ্টেন্সি। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট আর থার্ডম্যানের মাঝামাঝি আপার কাটে ধোনি যথেচ্ছ রান তুলছেন দেখেও থার্ডম্যানকে পিছিয়ে দিলেন না। যখন দিলেন, দেরি হয়ে গিয়েছে। আর সব চেয়ে কালান্তক ভুল, গ্রেম সোয়ানের দশটা ওভার তৃতীয় ব্যাটিং পাওয়ার প্লে-র আগেই খাইয়ে দেওয়া। টিমের সেরা বোলারের কোটা কোন আক্কেলে এত আগে শেষ করে দিলেন, সে কেবল কুকই জানেন। এই ভুল পাড়ার ম্যাচে করলেও ক্যাপ্টেন বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় খাবে কোচের কাছ থেকে। থাপ্পড় অবশ্য কুকও খেলেন এবং সেটা ১৬৪ সিক্কার! শেষ ১৫ ওভার তো টি-টোয়েন্টি দেখতে হল। ‘এবার দিল্লি চলো।’ পরের ম্যাচ সোমবার, রাজধানীতে। সব হিসেব উল্টে দিয়ে টগবগে ভারত আর তুমুল ধাক্কা খাওয়া ইংল্যান্ড। সব ভাল যার শুরু ভাল!
|
স্কোর
|
ভারত |
পার্থিব রান আউট ৯
রাহানে স্টাঃ কেইসওয়েটার বো সোয়ান ১৫
গম্ভীর এলবিডব্লিউ ডার্নবাখ ৩২
কোহলি ক পিটারসেন বো পটেল ৩৭
রায়না ক বেয়ারস্টো বো ফিন ৬১
ধোনি ন.আ. ৮৭
জাডেজা রান আউট ২৭
অশ্বিন রান আউট ৮
প্রবীণ ন.আ. ১
অতিরিক্ত ২৩
মোট ৫০ ওভারে ৩০০-৭।
পতন: ১৭, ৫২, ৭৯, ১২৩, ১৯৫, ২৬০, ২৮২।
বোলিং: ব্রেসনান ১০-০-৬৬-০, ফিন ৯-০-৬৭-১, ডার্নবাখ ১০-০-৫৮-১,
সোয়ান ১০-১-৩৫-১, পটেল ৮-০-৪৯-১, বোপারা ৩-০-২১-০।
|
ইংল্যান্ড |
কুক ক বিনয় বো জাডেজা ৬০
কেইসওয়েটার ক ধোনি বো প্রবীণ ৭
পিটারসেন রান আউট ১৯
ট্রট বো জাডেজা ২৬
বোপারা ক ও বো অশ্বিন ৮
বেয়ারস্টো ক ও বো জাডেজা ৩
পটেল বো যাদব ১৬
ব্রেসনান স্টাঃ ধোনি বো অশ্বিন ৪
সোয়ান বো যাদব ৮
ফিন ন.আ. ১৮
ডার্নবাখ বো অশ্বিন ২
অতিরিক্ত ৩
মোট ৩৬.১ ওভারে ১৭৪।
পতন: ৭, ৪০, ১১১, ১২০, ১২৪, ১২৬, ১৩৪, ১৪৮, ১৬৩।
বোলিং: প্রবীণ ৮-১-৩৮-১, বিনয় ৫-০-২৪-০, কোহলি ৩-০-১১-০,
যাদব ৫-০-৩২-২, অশ্বিন ৮.১-০-৩৫-৩, জাডেজা ৭-০-৩৪-৩। |
|
|
|
|
|
|
|