মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণে প্রবেশের পর হইতে বিভিন্ন উপলক্ষে এই বার্তা দিতে চাহিয়াছেন যে, তিনি বিভেদের কারিগর নহেন, মিলনের সেতুনির্মাতা। দার্জিলিঙের পাহাড়ে ও ডুয়ার্সের সমতলে তাঁহার সফর আরও এক বার সেই সংকেত বহন করিয়াছে। দার্জিলিঙ সফরে গিয়া তিনি এক গুচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্প ঘোষণার ফাঁকে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার শীর্ষ নেতৃত্ব সহ পাহাড়বাসীর মন এমন ভাবে জয় করিয়া লইয়াছেন যে তাঁহারা মুখ্যমন্ত্রীকে ‘বাংলার মা’ বলিয়া গণ্য করিতেছেন। আবার ডুয়ার্স-তরাইয়ের মানুষকে, বিশেষত জনজাতিদের মুখ্যমন্ত্রী আশ্বস্ত করিয়াছেন এই বলিয়া যে, তাঁহারা যেন এই বঙ্গ প্রদেশ ছাড়া অন্য কোনও ‘ল্যান্ড’-এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অমূলক শঙ্কায় না ভোগেন। উভয় ক্ষেত্রেই মমতার অর্জন হইল, আপাত-বিরোধী দুই জনগোষ্ঠীর আস্থা লাভ করা এবং তাহাদের পরস্পরের কাছে টানিয়া আনা। পাহাড়ের গোর্খারা যাহাতে না ভাবেন, সমতল তাঁহাদের উপর আধিপত্য কায়েমে উদ্যত। আবার ডুয়ার্সের জনতাও না ভাবেন, তাঁহাদের অতঃপর গোর্খাদের বশ্যতা স্বীকার করিয়া চলিতে হইবে। নূতন ভাবনার সূত্রপাত হিসাবে ইহার গুরুত্ব কম নহে।
পার্বত্য দার্জিলিঙ ও ডুয়ার্সের সমস্যা উত্তরবঙ্গের অনুন্নয়ন ও বঞ্চনার বৃহত্তর সমস্যার অন্তর্গত হইলেও আলাদা করিয়া সেগুলির মীমাংসা প্রয়োজন। কিন্তু এত কাল সেই অভিমুখে যথার্থ কোনও রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক চেষ্টা করা হয় নাই। প্রশাসনিক ভাবে মূলত হুমকি ও দমননীতির আশ্রয় লওয়া হইয়াছে। আর রাজনৈতিক ভাবে অবলম্বন করা হইয়াছে বিভেদপন্থা। কখনও সমতলকে পাহাড়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। কখনও কোচ-রাজবংশীদের সহিত গোর্খাদের, কখনও বাংলাভাষীদের সহিত নেপালিভাষীদের। ফলে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস, এমনকী বিদ্বেষও মাথা চাড়া দিয়াছে। প্রায়শ প্রশাসনিক কর্তব্য অসম্পূর্ণ বা অনারব্ধ রাখিয়া রাজনৈতিক দলের ক্যাডার-সমর্থকদের দিয়া দুর্বল ও প্রান্তিক মানুষদের ন্যায্য দাবি দলন করা হইয়াছে। কি পাহাড়, কি ডুয়ার্স, সর্বত্রই সরকার ও তাহার নিহিত অভিপ্রায়কে মানুষ সন্দেহের চোখে দেখিতে অভ্যস্ত হইয়াছেন। ফলে হিংসা, বলপ্রয়োগ, হুমকি, ভীতিপ্রদর্শনই হইয়া উঠিয়াছে দস্তুর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসিয়াই সর্বাগ্রে এই অবিশ্বাস দূর করিয়া পাহাড় ও ডুয়ার্সের আস্থা অর্জন করিতে সচেষ্ট হন। তাঁহার এই প্রয়াস প্রাথমিক ভাবে সফল হইয়াছে, অন্তত সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে সংশয় তিনি দূর করিতে সক্ষম হইয়াছেন। কয়েক মাসের মধ্যেই বারংবার পার্বত্য দার্জিলিং সফর করিয়া তিনি বুঝাইয়া দিয়াছেন, মহাকরণের অলিন্দ হইতে তাঁহার সরকার দূর-নিয়ন্ত্রণে পাহাড় বা ডুয়ার্স শাসন করিতে চাহে না, বরং সরকারকে, প্রশাসনকে পাহাড় ও ডুয়ার্সের কাছে লইয়া যাওয়া হইবে। এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা জরুরি। ঔপনিবেশিক আমলেও গ্রীষ্মকালে রাজ্যের সাময়িক রাজধানী পাহাড়ে স্থানান্তরিত হইত। গ্রীষ্মের কারণে না হোক, পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃত সংহতির কারণে সেই ঐতিহ্য ফিরাইয়া আনা দরকার।
এই পরিবর্তনের সম্ভাবনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তৈয়ারি করিয়াছেন। ঔদ্ধত্যের বদলে তিনি সহানুভূতি লইয়া হাজির হইয়াছেন। জনসাধারণের দাবিদাওয়াগুলি জানিতে চাহিয়াছেন এবং সাধ্যমত তাহা পূরণ করার নিষ্ঠা দেখাইয়াছেন। প্রশাসনের এই মানবিক মুখটি এ রাজ্য বিগত কয়েক দশক দেখে নাই। তবে এই পরিপ্রেক্ষিতেই একটি প্রশ্ন উঠিতে পারে। সকলকে সঙ্গে লইয়া চলিবার এই সদর্থক আবেগের সহিত পশ্চিমবঙ্গের নাম লইয়া মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগটি কি সঙ্গতিপূর্ণ? ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ রদ করিয়া ইংরাজি হরফেও ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটি কেন লেখা হইবে? সেই নাম কি মিলনের, অন্তর্ভুক্তির? তাহা কি অ-বাংলাভাষীকে দূরে সরাইয়া রাখিবার প্রেরণা নহে? |