শ্বেত শুভ্র নয়। সম্পূর্ণ গোলাপি। তফাত রয়েছে সময়েরও। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর।
পত্নী মমতাজের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে কুড়ি বছর ধরে রাজকোষ প্রায় শূন্য করে তাজমহল গড়ে তুলেছিলেন মোগল সম্রাট শাহজাহান।
আর মাত্র চার বছরের চেষ্টায় জীবদ্দশাতেই নিজের মূর্তি সম্বলিত এক বিশাল সৌধ-সহ উদ্যান গড়ে তুললেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী! যমুনার পূর্ব পাড়ে। রাজ্যের কোষাগার থেকে এ জন্য ব্যয় করা হল প্রায় ৬৮৫ কোটি টাকা। এই উদ্যানে অবশ্য মায়াবতীর পাশাপাশি বি আর অম্বেডকর, কাঁসিরামেরও মূর্তি আছে।
যমুনার পশ্চিম পাড়ে শাহজাহানের তাজমহল। আর পূর্ব পাড়ে ৮৪ একর জমি জুড়ে গড়ে ওঠা এই বিশাল উদ্যান যেন এক আধুনিক তাজমহল। যার পোশাকি নাম, ‘রাষ্ট্রীয় দলিত প্রেরণাস্থল’। মায়াবতীর দল, বহুজন সমাজ পার্টির এক নেতার কথায়, “দলিতদের জন্য তাজমহল বানিয়েছেন বহেনজি!” গোলাপি পাথরে তৈরি বৌদ্ধযুগের স্থাপত্যশৈলিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় দলিত স্মারক এবং একাধিক দলিত নেতার মূর্তি-সহ গোটা উদ্যানটি আজ রাজ্যের জনগণকে উৎসর্গ করলেন মায়াবতী।
অবশ্য এই উদ্যান গড়ে তুলতে গিয়ে কম ঝামেলা পোয়াতে হয়নি মায়াবতীর সরকারকে। ওই উদ্যান গড়তে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে বলে এক সময় কাজ বন্ধ করে দিয়ে পরিবেশ মন্ত্রককে গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলে সুপ্রিম কোর্ট। অভিযোগ, মায়াবতীর স্বপ্নের উদ্যান গড়ে তুলতে গিয়ে অন্তত হাজার ছয়েক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। পরে অবশ্য প্রয়োজনীয় সবুজ রক্ষার প্রতিশ্রুতি পেয়ে নির্মাণে ছাড়পত্র দেয় শীর্ষ আদালত। তার উপর বিপুল অর্থ ব্যয়ের জন্য আগাগোড়াই সমালোচনা করেছে রাজ্যের বিরোধী দলগুলি। আজ উদ্বোধনী মঞ্চে দাঁড়িয়ে সে সবেরই জবাব দিলেন ‘দলিত কি বেটি’ মায়াবতী। আর তাঁর এই ‘জবাব’ আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনের বিউগল বাজিয়ে দিল বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক নেতারা। |
নয়ডায় রাষ্ট্রীয় দলিত প্রেরণাস্থলে নিজেরই বিশালাকার মূর্তির সামনে মায়াবতী। ছবি: পি টি আই |
স্বাভাবিক ভাবেই আজ মায়াবতীর তীব্র সমালোচনা করেছে মায়াবতীর বিরোধী সবক’টি রাজনৈতিক দল। কংগ্রেস সরাসরি একে অর্থের অপচয় বলে মন্তব্য করেছে। অনেকেই বলছেন, আগামী বছর বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যবাসীকে চমক দিতেই মায়াবতীর এই বৈভব-প্রদর্শন। সমালোচকরা যা-ই বলুন, মায়াবতী কিন্তু তাঁর এই কাজের মধ্যে ‘অন্যায়’ কিছু দেখছেন না। তাঁর বক্তব্য, দলিতদের সামাজিক রূপান্তরের সংগ্রামকে তুলে ধরতেই এই পাকর্র্টিকে গড়ে তোলা হয়েছে।
শুক্রবারের সন্ধ্যায় নয়ডার অম্বেডকর পার্কের মধ্যে গড়ে ওঠা এই ‘রাষ্ট্রীয় দলিত প্রেরণাস্থল’-এর উদ্বোধনে অনেক চমকই ছিল। প্রমাণ মাপের একাধিক দলিত নেতার মূর্তি (যার মধ্যে মায়াবতীর নিজেরটিও রয়েছে), পাথরের তৈরি ২০টি বিশাল হাতি (মায়াবতীর দলের নির্বাচনী প্রতীক)-সহ অনেক কিছু। কিন্তু আজ সব আকর্ষণ ছিল ‘বহেনজি’কে ঘিরেই।
যেন এক মায়া-কার্নিভাল!
যেখানে তিনিই সব। যে ভাবে তাঁর জন্মদিনকে দলের ‘উৎসব’ করে তুলেছেন বিএসপি কর্মীরা। বলা হয়, নেত্রীর জন্মদিন উত্তরপ্রদেশের দলিত সমাজের কাছে এক ‘মহা-গুরুত্বপূর্ণ’ দিন। সেই ‘বহেনজি’র স্বপ্নের উদ্যানের উদ্বোধনের দিনটিতেও তার ব্যতিক্রম হল না।
ঠিক পাঁচটা নাগাদ মায়াবতী এসে পৌঁছলেন অনুষ্ঠানস্থলে। সঙ্গে প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা। গোটা এলাকা জুড়ে তখন তুমুল জয়ধ্বনি। মায়াবতী সোজা ঢুকে যান সৌধের ভিতরে। সেখানে তিন জনের বিশালাকায় মূর্তি। একেবারে মাঝে বি আর অম্বেডকর। তাঁর এক পাশে কাঁসিরাম ও অন্য পাশে ব্যাগ হাতে মায়াবতীর আবক্ষ মূর্তি। স্বপ্নের সৌধ গড়ে তোলার সাফল্যে উচ্ছ্বসিত মায়াবতী বাকি দুই মূর্তির সঙ্গে নিজের মূর্তিতেও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করলেন! এর পর সঙ্গী আমলা-কর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরে দেখেন গোটা সৌধটি। দেওয়ালের মূর্তি, ম্যুরাল যেখানে যা পছন্দ-অপছন্দ, তা নিয়ে আধিকারিকদের সঙ্গে একপ্রস্থ মামুলি আলোচনা সেরে নেন। দেন প্রয়োজনীয় নির্দেশ।
এর পর তরতরিয়ে সোজা বক্তৃতা মঞ্চে। সেখানে কোনও ঘোষক নেই! মঞ্চে উঠেই শুরু করে দেন বক্তৃতা। আর সেখানেই চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করেন কংগ্রেস-বিজেপি উভয় পক্ষকে।
উত্তরপ্রদেশে ২০০৭ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই এই পার্কটি বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মায়াবতী। যা নিয়ে গোড়া থেকেই বিরোধীরা তাঁর সমালোচনায় মুখর। আজ এক দিকে কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ তাঁকে ‘দলিতের বেটি না দৌলতের বেটি’ বলে আক্রমণ শানিয়েছেন। অন্য দিকে, প্রায় সাতশো কোটি টাকা খরচ করে উদ্যান না বানিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা সড়কের মতো বুনিয়াদি পরিকাঠামোতে ওই টাকা খরচ করা উচিত ছিল বলে তীব্র সমালোচনা করেছে বিজেপি।
যদিও বিরোধীদের ওই আক্রমণ একপাশে সরিয়ে নির্বাচনের আগে ফের দলিত ভাবাবেগকেই উস্কে দিতে চেয়েছেন মায়াবতী। তাঁর কথায়, “দলিতদের জন্য স্বাধীনতার পর থেকে উত্তরপ্রদেশে কিছুই করেনি কংগ্রেস সরকার। যা হয়েছে, তা আমার আমলেই।” তিনি আক্রমণ করেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীকেও। মায়াবতীর দাবি, বিজেপি শাসনের সময় যখন তাঁর বিরুদ্ধে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন মামলা শুরু হয়েছিল, তখন সনিয়া তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে সব মামলা থেকে মুক্ত করা হবে। মায়াবতী এ দিন বলেন, “এত দিনেও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি কংগ্রেস।” জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণির জন্য আর্থিক সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতিও কেন্দ্র রাখেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি। প্রায় চল্লিশ মিনিট বক্তব্য রাখেন তিনি।
আজ বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ স্থানীয় স্কুলের মাঠে মায়বতীর হেলিকপ্টার অবতরণের কথা থাকলেও গত কাল রাত থেকেই সমর্থকেরা ভিড় জমাতে শুরু করেন সভা প্রাঙ্গনে। বিএসপি সূত্রে দাবি করা হয়েছে, হাজার পঞ্চাশেক লোক জড়ো হয়েছিলেন ‘বহেনজি’র সভায়। অনুষ্ঠানের জন্য দুপুর থেকেই নয়ডা ও গ্রেটার নয়ডার বিভিন্ন রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে সমস্যায় পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। ছিল নিরাপত্তার বিপুল আয়োজন। নয়ডা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সভা উপলক্ষে প্রায় আড়াই হাজার পুলিশকর্মী এ দিন বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয় । এ ছাড়া বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল, এনএসজি কম্যান্ডোদের একটি দলও সবর্ক্ষণ সভাস্থল ঘিরে ছিল। ছিলেন রাজ্য পুলিশের একাধিক শীর্ষ কর্তা। তার মধ্যেই সভা শেষ করে গ্রেটার নয়ডার উদ্দেশে রওনা হয়ে যান দলিত নেত্রী।
প্রদোষের আলোয় তখন রক্তিম হয়ে উঠছে মায়াবতীর ‘তাজমহল।’ |