|
|
|
|
অর্থনীতি নামক বিজ্ঞানের স্বীকৃতি এই নোবেল |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই অর্থনীতিবিদ টমাস সার্জেন্ট এবং ক্রিস্টোফার সিমস।
প্রথম জন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কলে প্রফেসর অফ ইকনমিকস অ্যান্ড বিজনেস, দ্বিতীয় জন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যারল্ড হেল্ম্স প্রফেসর অফ ইকনমিকস অ্যান্ড ব্যাঙ্কিং। সত্তরের দশকে ‘র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনস’ তত্ত্বের স্থপতিদের অন্যতম টমাস সার্জেন্ট ম্যাক্রোইকনমিকসের এই নতুন ঘরানার দিকপাল পণ্ডিত। আর ক্রিস্টোফার সিমস ইকনোমেট্রিশিয়ান। র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনস তত্ত্বের ভিত্তিতেই তাঁর গবেষণা। ওঁদের নোবেলপ্রাপ্তির সংবাদে উচ্ছ্বসিত ভারতের অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক কৌশিক বসু। যিনি বলছেন, ‘খুব ভাল খবর। দু’জনেই অতি উঁচু মানের ম্যাথমেটিকাল ইকনমিস্ট। অবশ্যই এই সম্মানের যোগ্য।’
‘র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনস’ ব্যাপারটা কী রকম?
ধরা যাক, বন্ধুর সঙ্গে আপনার বাসস্টপে দেখা করার কথা বিকেল চারটেয়। কিন্তু আপনি জানেন, বন্ধুটি চিরকালের লেটলতিফ, আধ ঘণ্টা দেরি করবেনই। অতএব, আপনিও পৌঁছবেন সাড়ে চারটেয়। আর যে দিন সত্যিই চারটের সময়েই দেখা করার প্রয়োজন, সে দিন বন্ধুকে সাড়ে তিনটেয় আসতে বলবেন। অর্থাৎ যে ঘটনা একটা নিয়ম মেনে ঘটে, তাকে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং যুক্তির সাহায্যে ধরে ফেলা যায়। তাকে হিসেবে রেখে কাজও করা যায়। এবং এটাই ‘র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনস’ তত্ত্বের মূল কথা। যে তত্ত্বের দাবি: মানুষকে ‘বোকা বানানো’ যায় না।
যদিও সরকার মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে বইকি! |
টমাস সার্জেন্ট |
ক্রিস্টোফার সিমস |
|
যেমন মন্দার সময়ে সরকার বাজারে টাকার জোগান বাড়িয়ে দিতে পারে। তাতে সব জিনিসেরই দাম বাড়ে, মানুষের রোজগারও বাড়ে। সরকারের ইচ্ছে, মানুষ খরচ করুক, তাতে মন্দা কমবে। কিন্তু র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনস তত্ত্ব মোতাবেক, মানুষ যুক্তি দিয়ে ধরে ফেলবে, রোজগার তার একার বাড়ছে না, সবারই বাড়ছে। জিনিসের দামও বাড়ছে সমান তালেই। তার মানে, প্রকৃত আয় আগে যা ছিল, এখনও তা-ই আছে। আর এটা বুঝে যাওয়া মানেই বাড়তি খরচ না-করা।
অর্থাৎ, সরকার টাকার জোগান বাড়িয়ে যা করতে চেয়েছিল, সেই চেষ্টাটা বানচাল। ধনতন্ত্রে কোনও সঙ্কট দেখা দিলে সরকার সেই সমস্যার সমাধান করতে পারে এই বিশ্বাসের মূলে আঘাত করাই র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনস তত্ত্বের সবচেয়ে বড় বিপ্লব। সেই হিসেবে মিলটন ফ্রিডম্যানের দর্শনের উত্তরসাধক বলাই যেতে পারে টমাস সার্জেন্টদের।
ক্রিস্টোফার সিমস এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, সরকারের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। যেমন, মূল্যস্ফীতির হার কী হবে, সেটা অনেক সময়েই সরকার আগে থেকে বেঁধে দিতে চায়। কিন্তু সরকারের বাজেটে ঘাটতি যদি খুব বেশি হয়, তা হলে মূল্যস্ফীতি বেঁধে দেওয়ার এই চেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে, এমনকী হিতে বিপরীত হওয়ারও আশঙ্কা। কারণ, যে মূল্যস্ফীতির স্তরে পৌঁছনো যাবে না, সেটা লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা মানে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হওয়া। এরও ব্যাখ্যা সেই র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনস। মানুষ বিশ্বাস করবে, সরকার মুখে যা বলে, কাজে তা করতে পারে না।
গোটা দুনিয়া এখনও আর্থিক মন্দার প্রভাবে ধুঁকছে। প্রায় সব দেশের নেতারাই কেইনসীয় অর্থনীতির শরণাপন্ন যে অর্থনীতির দর্শন বলে, মন্দার সময়ে সরকার খরচ বাড়ালে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। যে কেইনসীয় দর্শনকে কার্যত অচল ঘোষণা করে র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনস তত্ত্বের উত্থান, গত কয়েক বছরে তার পুনরুত্থান দেখল বিশ্ব। এই পরিস্থিতিতে সার্জেন্ট আর সিমসের নোবেলপ্রাপ্তি কি কোনও বার্তা বহন করছে?
কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকারের জবাব, “এটা একটা সঙ্কেত হতেই পারে। যার বক্তব্য, ধনতন্ত্র তার নিজের অসুখ নিজেই সারাতে পারে, তার জন্য সরকারের প্রয়োজন নেই।”
না কি, অর্থশাস্ত্র যে বিজ্ঞান, সেটাই প্রমাণ হল এই পুরস্কারে?
বিজ্ঞানের তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব মিলবেই এমন দাবি অর্থহীন। বিজ্ঞান তার নিজস্ব যুক্তির অকাট্যতায় সুন্দর। ধনতন্ত্রের সঙ্কট নিয়ে যখন অনেক কথা, তখনই র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনস তত্ত্বের এই নোবেলপ্রাপ্তি কি সেই সৌন্দর্যের স্বীকৃতি?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক কল্যাণ সান্যাল বললেন, “রোনাল্ড রেগনের জমানায় যখন র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনস তত্ত্ব তার শিখরে পৌঁছেছিল, তখনও সরকারি নীতিতে কেইনসের উপস্থিতি ছিলই। এখনও আছে। কিন্তু সেই বাস্তব প্রয়োগের সঙ্গে যে তাত্ত্বিক অর্থনীতির সম্পর্ক নেই, নোবেল কমিটি সে কথাটি মনে করিয়ে দিল। বলে দিল, অর্থনীতি বিজ্ঞান। আর বাস্তবে কী ঘটছে, তার সঙ্গে বিজ্ঞানের তত্ত্বের গুরুত্বের সম্পর্ক নেই।” |
|
|
|
|
|