পুজোর মরসুমে এ বার সুদিনের স্বপ্ন দেখছে চিৎপুর।
নতুন বছরের গোড়ায় নয়, যাত্রাশিল্পের হালখাতা হয় ষষ্ঠীতে। ঘটপুজো করে শুরু হয় নতুন পালার যাত্রা। বিভিন্ন জেলা থেকে নায়েকরা জড়ো হন। বিভিন্ন ঘরে গিয়ে মহড়া দেখে পালার বায়না করেন, টাকা মিটিয়ে দেন। ফলে বছরভর ব্যবসা কেমন যাবে, তার হালচালও বোঝা যায় ষষ্ঠী থেকেই। সেই হালচাল দেখেই চিৎপুর এ বার আশায় বুক বাঁধছে। গত তিন বছরের মন্দা কাটিয়ে ওঠার আশা।
চিৎপুরে এ বার বড় চমক মুম্বইয়ের দুই নায়িকা। রবিনা টন্ডন এবং পদ্মিনী কোলাপুরি। প্রথম জন করছেন ‘রূপসাগরে রূপসী’।
আর দ্বিতীয় জন ‘চিরদিনের সাথী’। গত কয়েক বছর ধরে মাওবাদী আতঙ্কে বেশ কয়েকটি জেলায় মার খেয়েছিল চিৎপুরের পালাগান। এ ছাড়াও ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কোনও প্রযোজকই বেশি টাকা ঢালতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তাই মুম্বই থেকে বিগ বাজেটের নায়ক-নায়িকার আগমনও
খুব বেশি ঘটেনি। এ বার কি তবে পরিবর্তনের হাওয়া লাগল চিৎপুরেও?
সত্যনারায়ণ অপেরার দিলীপ দাশ নতুন প্রযোজনা ‘মউবনের ময়ূরী’ পালায় নায়িকা নির্বাচন করেছেন রায়দিঘির বিধায়ক দেবশ্রী রায়কে। “পরিবর্তনের হাওয়ায় নতুন আশার আলো”, হেসে বললেন তিনি। “ষষ্ঠীতে ঘটপুজো সেরেই প্রথম দুর্গাপুরে পা। তার পর আর পিছনে তাকানোর সময় নেই,” উচ্ছ্বসিত তিনি। পরিবর্তনের হাওয়া ধরতে অঞ্জলি অপেরার কর্ণধার তাপস দাশ নিয়ে এসেছেন পালা ‘বাংলার মসনদে মমতা’। বললেন, “নায়েকের দল ষষ্ঠী থেকেই আমাদের সব ‘ডেট’ নিয়ে নিয়েছেন।”
গত তিন বছর কিন্তু যাত্রার বাজারে ভাল রকম মন্দা গিয়েছিল। জঙ্গলমহলের জেলাগুলোয় নায়েকের দল চিৎপুরমুখীই হননি। লালগড়-বিনপুর-শিলদা-ঝাড়গ্রাম-বেলপাহাড়ি-জামবনি-মায়াগ্রাম-সহ মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, বাঁকুড়ার খাতরা-সিমলাপাল-তালডাংড়া-রায়পুর-রানিবাঁধ-সারেঙ্গা-সহ বেশ কয়েকটি থানা, পুরুলিয়ার বান্দোয়ান-আড়শা-বলরামপুর-মানবাজার যাত্রা বন্ধ হতে বসেছিল প্রায়। কয়েক জন প্রযোজকের দাবি, “শুধুমাত্র জঙ্গলমহলেই এক এক বছরে বাতিল হয়ে গিয়েছে কম করেও ২৫০টি শো।” মানুষ সন্ধের পর বেরোচ্ছিলেন না। নায়েকরা পালা আনতে ভরসাও পাচ্ছিলেন না।
এ বার ছবিটা অনেকটা অন্য রকম।
জঙ্গলমহল থেকে আতঙ্ক উধাও হয়ে গিয়েছে এমন নয়। কিন্তু পরিস্থিতি গত বারের চেয়ে খানিকটা ভাল হওয়ায় নায়েকের দল আবার চিৎপুরে ভিড় জমিয়েছেন। যে সব জেলা থেকে যাত্রার বায়না প্রায় আসছিলই না, সেগুলি আবার ফিরে এসেছে। মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া থেকে ইতিমধ্যেই ৭০ শতাংশ পালার বায়না এসে গেছে। সেই ভরসাতেই প্রযোজকরা মুম্বই থেকেও কলাকুশলী আনতে উদ্যোগী হয়েছেন। এক যুগ পরে রবিনা ও পদ্মিনীর মতো নায়িকারা বাংলার যাত্রাপালায় এলেন।
বিভিন্ন দলের ঘরে ঘোরাঘুরি করছিলেন বীরভূমের নায়েক নিরঞ্জন সর্দার। তাঁর খাতায় ৬টি দলের লেটার মার্কস জ্বলজ্বল করছে। হেসে বললেন, “অনেক দিন পর ব্যবসার মুখ দেখলাম।” উত্তর দিনাজপুরের মহম্মদ আকবর আলি নির্বাচন করেছেন ১০টি পালা। তাঁর কথায়, “অনেক দিন পর লাভের নেশা ধরছে। বাজার ভাল। উৎসাহী অনেকেই।”
বাজারের অঙ্কটা কী? কোনও জেলায় কোনও প্রযোজনার জন্য ৩০টিও বায়না না এলে বলা হয়, অমুক জেলায় এ বার মন্দা যাবে। আর ১০০টির মধ্যে ৭০টির বুকিং হয়ে গেলে বলা হয়, বাজার খুব ভাল। পশ্চিম মেদিনীপুরের নায়েক বিমল পন্ডা জানালেন, একেকটি পালা থেকে সব খরচ বাদ দিয়ে তাঁদের পকেটে আসে গড়পড়তা তিন হাজার টাকা। এ বার কম করেও ২৫টি পালার দায়িত্ব নিতে পেরেছেন বলে গর্বিত বিমল। তবে অন্য কয়েকটি জেলায় এ বারও বন্যা হয়েছে। শিল্পমন্দির যাত্রাপালার প্রযোজক ও অভিনেতা অনল চক্রবর্তী বললেন, “বন্যার একটা প্রভাব পড়বেই পড়বে যাত্রাশিল্পে।” কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত বড় প্রতিবন্ধকতা হবে না বলেই মনে করছেন প্রযোজকরা। রত্নদীপ অপেরার কনক ভট্টাচার্য বললেন, “গত বছরও রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে পালার বুকিং ছিল ৭০টি। এ বার আরও বেশি আশা করছি।” বিশ্বভারতী অপেরা, আনন্দভারতী অপেরা ও কলকাতা অপেরার প্রযোজক সমীর সেনের মুখও উজ্জ্বল। “আশায় আছি তিনটি প্রযোজনাই এ বার লাভের মুখ দেখাবে।”
পরিবর্তনের হাওয়াতেই ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় যাত্রাপাড়ায়। |