দশ মাস পরে বাড়িতে ঝাঁট পড়েছে।
পুজো যে!
দশ মাস পরে লোকের আনাগোনা।
পুজো বলে কথা!
দশ মাস পরে মন্দির পরিষ্কার।
পুজো বন্ধ থাকবে, তা হয় নাকি!
অতএব বাগবিন্ধ্যার একমাত্র দুর্গাপুজো এ বছরও হচ্ছে। আতঙ্ককে সঙ্গী করে। দুঃস্বপ্নের স্মৃতি বুকে নিয়ে।
গত বছর ১৬ ডিসেম্বর রাতের দুঃস্বপ্ন। অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে, ঝালদা ১ ব্লকের এই গ্রামে যে রাতে এক সঙ্গে সাত-সাত জনকে খুন করেছিল মাওবাদীরা। মহিলা পঞ্চায়েত প্রধান থেকে ফরওয়ার্ড ব্লক কর্মী-সমর্থক। নিহতদের তালিকায় নাম ছিল এমন অনেকেরই। ছিল কালীকিঙ্কর সিংহের নাম। ফরওয়ার্ড ব্লকের বাগবিন্ধ্যা বুথ কমিটির তরুণ সম্পাদক। বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে মাথায় গুলি করে মেরেছিল মাওবাদীরা। |
সেই কিঙ্করের বাড়িতেই পুজো। বাগবিন্ধ্যা ‘রাজবাড়ির’ পুজো। এটাই গ্রামের একমাত্র দুর্গাপুজো। কালীকিঙ্করদের পূর্বপুরুষেরা গ্রামের জমিদার ছিলেন। তাই বাসিন্দারা একে ‘রাজবাড়ি’র পুজো বলেন। মূর্তি পুজো হয় না। দু’টি তরোয়াল ও মঙ্গলঘট পূজিত হয়। সেই পুজো বন্ধ রাখতে চায়নি কিঙ্করদের পরিবার। দুরুদুরু বুকেই পুজোর উপচার সাজাচ্ছেন কিঙ্করের মা, দাদা ও বৌদি। ১৬ ডিসেম্বরের পরে সেই যে বাড়ি বন্ধ করে ঝালদার ভাড়াবাড়িতে চলে যান তাঁরা, বাগবিন্ধ্যায় পা রেখেছেন জিতাষ্টমীতে। মাওবাদীদের ভয়ে গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দা ভোটও দেননি। তবে গ্রামের একমাত্র পুজো বলেই অল্প অল্প হলেও লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে সিংহ বাড়িতে।
কিঙ্করের দাদা শঙ্কর সিংহের কথায়, “এখনও যা অবস্থা, তাতে গ্রামে বাস করতে কারও সাহসে কুলোচ্ছে না। তবু বাড়ির পুজো তো, গ্রামেরও একমাত্র পুজো। সেই পুজোর জন্যই ঝালদা থেকে আসা-যাওয়া করছি।” বাড়ির উঠোন লাগোয়া মন্দির। বহু দিন ঝাঁট পড়েনি, কেউ ধূপধুনোও দেয়নি। পুজোর কাজ তদারকি করতে করতে শঙ্করবাবু বললেন, “আগে কখনও পুজোর কাজ দেখাশোনা করতে হয়নি। ভাই-ই পুজোর আয়োজন করত। তাই ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে।” তাঁর মা শকুন্তলাদেবী বলেন, “কিঙ্করই তো একা হাতে সব কিছু সামলাত। বাচ্চাদের জন্য নতুন জামা কাপড় কেনা থেকে শুরু করে বাজার করা, সব ছিল ওর দায়িত্ব। ওকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সেই রাতটা যে কী ভাবে কেটেছে! ভাবতে গায়ে কাঁটা দেয়!” শঙ্করবাবুকেও মাওবাদীরা তুলে নিয়ে যায়। কিঙ্করের অনুরোধেই তাঁকে মাওবাদীরা ছেড়ে দেয়। শঙ্করবাবুর স্ত্রী গীতারানিদেবীর কথায়, “বাড়ি ঢুকে মনটা হু হু করে উঠেছিল। পুজো মানেই শুধু কিঙ্করের স্মৃতি।” পাশ থেকে শকুন্তলাদেবী বলেন, “যত ক্ষণ বেঁচে আছি, তত ক্ষণ স্বামী-শ্বশুরের পুজো তো বাদ দিতে পারি না। ভয় নিয়েও বাড়িতে এসেছি।” পুজো করলেও, রাতটা গাঁয়ে থাকছেন না। ঝালদা থেকে বাগবিন্ধ্যায় আসা-যাওয়া করছেন। শঙ্করবাবুর কথায়, “পুজোর সময় অনেক আত্মীয়েরা আসতেন। সে সব কোথায় গেল! বিকেলের আগেই বাড়ি ছাড়ছি। কখন ওরা ফিরে আসে বলা তো যায় না।” বাড়ির পিছনে অযোধ্যা পাহাড়ের গায়ে তখন সূর্য হেলে পড়ছে। শঙ্করবাবুর সঙ্গী এক যুবক তাড়া লাগালেন, “দিন ফুরোচ্ছে। আর দেরি না করাই ভাল।” এটাই আসল বাগবিন্ধ্যা। আতঙ্ক যার সমার্থক। |