সারা দুনিয়া জুড়ে শত শত কলকাতা।
খোদ কলকাতা দুর্গাপুজোয় যখন তিলোত্তমা হয়ে উঠেছে, সারা পৃথিবীর বাঙালিরা মেতেছেন নিজেদের মতো করে ছোট্ট ছোট্ট কলকাতা বানানোয়। প্রবাসে। মেজাজটাই হচ্ছে, “কলকাতা নেই? তো কী? আমরা তো আছি!” কলকাতার পুজোর কাছে যেন লাখো লাস
ভেগাসের রোশনাইও ফিকে। আইফেল টাওয়ারের দ্যুতিও মলিন।
কাজের চাপে পুজোর দিন কমতে কমতে কখনও হয়তো উইকএন্ড-এ এসেও ঠেকেছে। তার মধ্যেই ঝটিতি অঞ্জলি সারা, চটজলদি ভোগ-প্রসাদ। কলকাতা থেকে বন্ধু-বান্ধব, মা-মাসি, আত্মীয়স্বজনদের কাছে আব্দার বা জোর-জবরদস্তি করে আনানো এক টুকরো পুজোর গন্ধ-মাখা শাড়ি-জামা জড়িয়ে নেওয়া। সে হেলসিঙ্কির সোমদত্তা দেব হোক বা টরন্টোর সৌম্য ঘোষ। “প্যান্ডেল, ভিড়, নতুন জামা, কাশফুল, পুজোবার্ষিকী, বিজয়া দশমীর ঘুগনি, এগরোল, ঢাকের আওয়াজ, কুচো নিমকি, নারকেল নাড়ু আর কোলাকুলি... দুর্গাপুজো শুনলেই অনেক রকম ছবি ভেসে ওঠে। এত বছর পুজো থেকে দূরে থেকেও ভেসে আসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ। বা লাউড-স্পিকারে বেজে যাওয়া সেই বছরের হিট গান। তবে সব চেয়ে বেশি করে মনে পড়ে বাড়ির কথা,” বলছেন সৌম্য।
আর এক টরন্টোবাসী রূপা দে বিশ্বাস কলকাতা থাকার সময় সে রকম ভাবে পুজোতে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু সেই মাতাল পরিবেশের কথা ভেবে কোথায় যেন চোরা মন খারাপ ঢুকে পড়ে তাঁর মনে। “সেই শরতের আকাশ থেকে বাজারের ভিড়, পাড়ার প্যান্ডেল, হঠাৎ প্যান্ডেল গজানোয় বাসের রুট বদলে যাওয়া, খবরের কাগজে ‘কোন সংঘ কী বানাল’-র চর্চা, চোখ-ধাঁধানো আলো, বাসের তীব্র হর্ন...এইগুলো খুব মিস করি,” বলছেন তিনি। |
বার্লিনের প্রবাসী শিবশঙ্কর দে’র কথায়ও এক সুর। “১৮ বছর কলকাতার পুজো দেখিনি। বন্ধুরা বলে, ‘যাস না! রাস্তায় লোকে লোকারণ্য! বেড়াতে পারবি না। ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হবে।’ আমি ভাবি জন্মেছি জন-অরণ্যে, বড় হয়েছি ধুলো মেখে, সেই আমি ঘরে বসে থাকব? ম্যাডক্স স্কোয়ার থেকে একডালিয়া, বাবুবাগান হয়ে বাগবাজার সর্বজনীন, সিমলা ব্যায়াম সমিতি, মহম্মদ আলি পার্ক ঘুরে লাইন দিয়ে, বিরিয়ানি খেয়ে আবার চলতে থাকা। এর কোনও বিকল্প নেই।”
সেই মেদুরতা খানিক রক্ত-মাংসে ফিরিয়ে আনতেই সৌম্য আর তাঁর বন্ধুবান্ধব মিলে এ বছর থেকে বিভুঁইয়ে শুরু করলেন পুজোর আয়োজন। নাম দিয়েছেন ‘আমার পুজো, টরন্টো’। পাড়ায় কুমোরটুলি থেকে লরি করে ঠাকুর আনার উদ্দীপনা তাঁরা ভাগ করে নিয়েছেন এয়ারপোর্টে গিয়ে মা’কে ‘রিসিভ’ করে। কুমোরটুলি থেকে মা এসেছেন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ-এ চেপে। “নিজেদের মধ্যে হল একটু মিষ্টিমুখ। সঙ্গে ইউ-টিউবে ঢাকের আওয়াজ।’’ আছে ‘আমার পুজো ব্লগ’ও। আনন্দে টইটম্বুর।
আনন্দের পুনরাবৃত্তি ঘটাতেই নেদারল্যান্ডসের তনিমা চট্টোপাধ্যায়রাও পুজো শুরু করেছেন। এই বছর তাঁদের পুজো দুইয়ে পড়ল। সপ্তমী থেকে দশমী, কলকাতার পুজোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে পুজো। নিষ্ঠার সঙ্গে পুজোর আচার পালন করা তো হয়ই! সঙ্গে থাকে আড্ডা, দেদার খাওয়া-দাওয়া, সাজগোজ আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তনিমা বলেন, “আমরা একটা শারদীয়া পত্রিকাও প্রকাশ করি। কলকাতায় থাকতে কখনও বাড়ি বা কমিউনিটির পুজোর অংশীদার হওয়ার সুযোগ হয়নি। এখানকার পুজো সেই সুযোগ করে দিল। যখন দেখি ঢাকের তালে কোনও বিদেশিনি নেচে উঠছেন, বা অশীতিপর কোনও বাঙালি সতীনাথের গানের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন, তখনই মনে হয় সার্থক এই বিদেশে পুজো কাটানো।”
শিবশঙ্কর দে বার্লিনের ঐতিহাসিক শহরে প্রত্যেক মহালয়ায় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শোনেন। “যত বার কলকাতায় যাওয়ার কথা ভাবি, পরক্ষণেই মনে হয়, আমাদের বার্লিন সর্বজনীনের কী হবে? এই শহরের ৪০ লক্ষ লোকের মধ্যে মেরে কেটে ২০০ বাঙালির এই তো একটাই পুজো। প্যান্ডেল বাঁধা থেকে রান্নাবান্না, ঠাকুর আনা, পুজোর পর তাকে বাক্স-বন্দি করা সব কিছুর মধ্যেই তো আমরা জড়িত। এ সব ছেড়ে যাই কী করে? আর একটা ছোট কলকাতাই বলা যায়।”
লন্ডনবাসী চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট সুরথ আর মঞ্জরী সেনগুপ্তর মা-বাবা কিছু দিন আগেই কলকাতায় ফিরে গিয়েছেন। “ওঁরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল
আমরা আর এক বার কলকাতার পুজো ‘মিস’ করব। খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা মারা, ঠাকুর দেখা। আচার-অনুষ্ঠান খুব একটা মিস করি না, কারণ এখানে সেটার
কোনও কমতি নেই। যদিও অষ্টমীর অঞ্জলিতে বিল্বপত্রের জায়গায় চন্দ্রমল্লিকা পাতা ব্যবহার করা হয়। সারা দিন ধরে অঞ্জলি চলে। যাতে আমাদের, মানে অফিসযাত্রীদের কোনও অসুবিধে না হয়।
ভাড়া করা হল বা গির্জায় কি আর দুর্গাপুজো
মানায়? আমরা মুম্বইয়ে গণেশ পুজো দেখেছি, এখন লন্ডনে বড় দিনও দেখছি। কিন্তু কলকাতার
দুর্গাপুজোর সঙ্গে কোনও কিছুরই তুলনা হয় না”, বলছেন সুরথ।
রানাঘাটের শাল্মলী গুহ বরের সঙ্গে এখন ইংল্যান্ডের ওকিং-এ। “এখানে একঘেয়ে বৃষ্টিতে মন ভাল হওয়া কঠিন। তাই নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছি। বড় বড় হলগুলোতে পুজো দেখতে মন্দ লাগে না। কিন্তু আমাদের পাড়ার খোলামেলা ভাবটা?” তাঁর বর শৈবাল একটা ওয়েবসাইটও তৈরি করেছেন পুজো উপলক্ষে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিজেকে রেখেছেন ফ্লোরিডার সুলগ্না মুখোপাধ্যায় বসুও। বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ ফ্লোরিডার সদস্য সুলগ্না অন্যদের সঙ্গে গত
বছর থেকে পুজো শুরু করেছেন। “আমাদের এ বছর পুজো দু’দিনের, পয়লা ও দোসরা অক্টোবর। সরস্বতী পুজোর
পর থেকে আমাদের দুর্গাপুজোর জন্যে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। প্রথম দিন ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমীর পুজো। দ্বিতীয় দিন নবমী আর দশমীর পুজো। ভোগের মেনুও ষোলো আনা বাঙালি। খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, দু’রকম তরকারি, ডালনা, লুচি, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি, পান। তার সঙ্গে দধিকর্মা,” বলছেন সুলগ্না। |