জন্মশতবার্ষিকীতে পড়েও সুঁটের
জন্য সেই বঞ্চনা আর তাচ্ছিল্য
সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায় স্টাম্পড অবহেলা বোল্ড হার্ট অ্যাটাক ৬৯।
সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায় হিট উইকেট বঞ্চনা ১০০।
দুটোই মৃত্যু। প্রথমটা বাস্তবের। পরেরটা প্রতীকী। সোমবার শতবর্ষে পা দিচ্ছেন বাংলা ও ভারতের প্রাক্তন কিংবদন্তি পেসার সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়। বেঁচে থাকলে ৩ অক্টোবর তাঁর বয়স হত ঠিক একশো। অবশ্য তা নিয়ে জীবজগতে কারও কোনও নড়নচড়ন, চাঞ্চল্য বা উত্তেজনা কিছুই নেই। সুঁটে যেমন ট্র্যাজিক নায়ক ছিলেন, তেমনই হয়ে থাকলেন জন্মশতবর্ষে পড়েও। প্রথমে বিস্মৃত, মাঝে বিস্মৃত, শেষেও সেই বিস্মৃত।
কোথাও অনুষ্ঠান-টনুষ্ঠান হওয়া দূরে থাক, নতুন করে সজ্জিত ইডেনের ক্লাবহাউসে তাঁর ছবি অবধি নেই।
পঙ্কজ রায় বেঁচে থাকলে অবধারিত বলতেন, ‘ফালটুস। সুঁটেটাকে ভুলে গেল?’ সুব্রত গুহ গলা নামিয়ে বলতেন, ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।’ আর অম্বর রায় সিগারেটে সুখটান দিয়ে বলতেন, ‘দুর! সুঁটেদা এ সবে অভ্যস্ত। কিছু মনে করছে না।’
অথচ তিরিশ থেকে পঞ্চাশ দশক অবধি পূর্বাঞ্চলীয় ক্রিকেটে সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়ের যা অবদান, তাতে তিনি উত্তম বা সৌমিত্র যদি বা না হন, বিকাশ রায় তো বটেই। ১৯৩৬ এবং ১৯৪৬ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ও পরে দুটো ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলেন। প্রথম সফরে যখন নির্বাচিত হন তখন প্রতিদ্বন্দ্বী মিডিয়াম পেসার ত্রয়ী ছিলেন মহম্মদ নিসার, অমর সিংহ আর জাহাঙ্গির খান। এই রকম মারাত্মক পেস বোলার ত্রয়ী ভারতীয় ক্রিকেটে আর আসেনি। তবু বঙ্গসন্তান এই বাংলা থেকে লড়েই দলে জায়গা করেছিলেন। পরের সফর ১৯৪৬, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীরা কেউ ছিলেন না। ওই সফরেই ওভালে শেষ উইকেটে চাঁদু সারওয়াতের সঙ্গে ২৪৯ রান যোগ করেছিলেন। বিপক্ষ ছিল সারে। ধন্য ধন্য পড়ে গিয়েছিল সুঁটে-সারওয়াতের সেই জোড়া সেঞ্চুরিতে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আজও শেষ উইকেটে ওটাই দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টনারশিপ। সুঁটেকে তবু খেলানো হয়নি সেই সফরে। পরবর্তী কালে ইডেন উদ্যানে বসে সেই বঞ্চনার গল্পও শুনিয়েছেন অনেককে। কী ভাবে পূর্বাঞ্চলের প্রতিনিধি বলে তাঁকে ব্রাত্য করে রাখা হত। এর পর ১৯৪৯-এ আচমকাই টেস্ট ক্রিকেটের দরজা খুলে যায় সুঁটের কাছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে একটাই টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন ব্রেবোর্নে। পাঁচ উইকেট নেন। শেষ ওভারে অপরাজিত অবস্থায় একটা ছক্কাও মেরেছিলেন। কিন্তু আর টেস্ট ম্যাচ পাননি। জীবনের প্রথম টেস্টে পাঁচ উইকেট নিয়েও আর ম্যাচ খেলার সুযোগ না পাওয়া, এমন হতভাগ্যের সন্ধান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩৮৫ উইকেটের অধিকারী (গড় মাত্র ২৬.৬৮) মানুষটি জীবনের একটা বড় অংশ খেলেছেন বিহারে। এটাও দুর্ভাগ্য যে পরবর্তীকালে বিহার বা বাংলা কেউ মনস্থির করতে পারেনি, সুঁটে আসলে কার। দু’রাজ্যের ক্রিকেট কর্তারাই তাঁকে সমান বঞ্চনা করে গিয়েছেন।
তাঁর জীবিত অশীতিপর বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কেউ কেউ মহাষষ্ঠীর দিনেও বুঝে উঠতে পারছিলেন না, এত বড় উৎসবের মাঝে সোমবার মহাসপ্তমীতে সুঁটের জন্মশতবার্ষিকীর জন্য একটা ছোট ক্রিকেট উৎসবের ব্যবস্থা কেউ করল না কেন। ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত কেউ কেউ অবশ্য সুঁটের অনাদরে এতটুকু আশ্চর্য নন। তাঁরা জানেন সুঁটে বরাবরই অনাদরেই অভ্যস্ত ছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর সংসারে সামান্য অর্থাভাব দেখা গিয়েছিল। বোর্ডের দেওয়া বেনিফিট ম্যাচের টাকা খরচ হয়ে যায় সংসার চালাতে। সেই সময়ে তাঁর এক পারিবারিক বন্ধু অরুণ লালকে গিয়ে জানান পরিবারের অর্থাভাবের কথা। সিএবি কর্তারা কোনও তৎপরতা দেখাননি। কিন্তু অরুণ লাল নিজে দু’বছর টানা পরিবারকে আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এর পর যখন বোর্ড জীবিত/মৃত টেস্ট ক্রিকেটারদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করল তখন আর অর্থাভাব হয়নি। পেনশনের অঙ্ক ছিল মাসে ২৫ হাজার টাকা। সল্টলেকের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে অধুনা সোদপুরের বাসিন্দা শ্রীমতি রমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই পেনশনের টাকাতেই জীবন চলে। এ দিন বহু চেষ্টা করেও সুঁটে-পত্নী রমা দেবীকে ধরা গেল না। পারিবারিক সূত্রে জানা গেল, শতবর্ষে স্বামীর জন্য অন্তত সামান্য সম্মান তিনি আশা করেছিলেন।
কী হল সুঁটের ব্যবহার করা ক্রিকেট সরঞ্জামের? দু-দুটো ইংল্যান্ড সফরে গেছেন। পাঁচটা বেসরকারি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। একটা সরকারি টেস্ট ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এত বাঘা বাঘা সব পারফরম্যান্স। অবশ্যই তাঁর স্মৃতি বিজড়িত অনেক সামগ্রী থাকার কথা। কোথায় গেল সে সব ব্লেজার, টুপি বা বল? এখানেও বিভ্রান্তি। পারিবারিক বন্ধু সুকুমার বিশ্বাস জানালেন, ওগুলো সিএবি-কে সেই কবে দিয়ে দেওয়া হয়েছে টাঙিয়ে রাখার জন্য। তখন সিএবি-র যুগ্মসচিব ছিলেন প্রবীর মুখোপাধ্যায়। প্রবীরবাবু এ দিন আনন্দবাজারকে বললেন, “দেওয়া হয়নি তো। দেবে বলেছিল।” সুকুমারবাবু পরিষ্কার মনে করতে পারছিলেন, “সিএবিকে দেওয়া হয়েছিল, ওরা ব্যবহার করার যোগ্য মনে করেনি।” এখনকার যুগ্মসচিব বিশ্বরূপ দে দুর্গাপুজো জাজিংয়ের এক ফাঁকে বিকেলে বললেন, “আমাদের ‘এল’ ব্লকে ফটো গ্যালারি হলে সুঁটেদার ছবি ভাল করে রাখব।”
উত্তর কলকাতা নিবাসী প্রবীরবাবু সুঁটেকে খুব ভাল চিনতেন। তিনি উল্টে স্থানীয় মিডিয়াকে দোষ দিতে চান। বলতে চান, বছর দুই আগে রাজ্যপাল গোপাল গাঁধী যখন সিএবি-তে এসে তাঁর ভাষণে বললেন ‘এই দেশ নিসার-অমর সিংহদের জন্ম দিয়েছে’, তখন একটা মিডিয়াও লেখেনি রাজ্যপাল ভূমিপুত্রকে ভুলে গেলেন কী করে? সুঁটেদার কথা কেন উনি বললেন না? এ হেন প্রবীরবাবুও কিন্তু জানেন না সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও ছবি সিএবি-তে আছে কি না। বিশ্বরূপ জানালেন, “ইন্ডোরে মনে হচ্ছে একটা আছে।” সুঁটেকে যাঁরা চিনতেন তাঁরা জানতেন তাঁর আত্মসম্মান বোধ ছিল কত প্রখর। ঘনিষ্ঠমহলে বঞ্চনার কথা আলোচনা করলেও শিরদাঁড়া কখনও তিনি ঝোঁকাননি। কর্তাদের তোয়াজ করেননি। এক বার একটা রঞ্জি ম্যাচে সিএবি-র সহ-সচিব দেখতে পান, সিএবি-র টিকিট কাউন্টারে লাইন দিয়ে টিকিট কাটছেন সুঁটে। তিনি অবাক হয়ে বলেন, ‘দাদা আপনি এখানে?’ সুঁটেবাবু বলেন, ‘কী দরকার? ওখানে কে কী বলবে। কার্ড চাইবে। তার চেয়ে এটাই ভাল।’ কর্তাটি তখন টেনে সুঁটেকে নিয়ে যান।
শতবর্ষে পড়েও বঞ্চনা আর লাঞ্ছনার ইতিহাস তাই মনে হয় না সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়কে আঘাত করত বলে। তিনি জেনে গিয়েছেন, কী বা জন্ম কী বা মৃত্যু, যন্ত্রণাতেই তাঁর একমাত্র অধিকার। উৎসবে নয়।

প্রথম শ্রেণি ম্যাচ ১৩৮ টেস্ট-১
রান ৩৭১৫
সর্বোচ্চ ১৩৮
গড় ২০.৬৩
সেঞ্চুরি ৫
উইকেট ৩৮৫
সেরা বোলিং ৮-২৫
গড় ২৬.৬৮
রান ১৩
সর্বোচ্চ ৮
উইকেট ৫
সেরা বোলিং ৪-৫৪




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.