একদা শরৎকালে সমস্ত বালক যখন খেলার বশে মত্ত, তখন উপনন্দ ছিল নিজ কর্মে বৃত। সেও বালক, সমবয়স্ক অন্যদের ন্যায় খেলাধুলার বাসনা যে তাহারও ছিল না, এমন ভাবিবার কারণ নাই। অথচ, তাহার কিছু কাজ ছিল, এবং সেই কাজটি যথাসময়ে করিতে হইবে, সেই দায়িত্বজ্ঞানও ছিল। সুতরাং, আনন্দের ডাক প্রত্যাখ্যান করিয়া সে বসিল পুঁথি নকল করিতে। এই বিচিত্র কর্ম-যোগটি দিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শারদোৎসব’ নাটকের সূচনা। ইহা আখ্যান বটে, কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক। বাস্তবও মাঝে মাঝে আখ্যানের বশবর্তী হয়। যেমন, গত রবিবার শারদীয় ছুটির আবহে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার কর্মীগণ কর্মস্থলে আসিয়া কাজ করিয়াছেন। যেমন, পূর্ণ ছুটির দিনেও পুলিশ অন্য আরও নানা অত্যাবশ্যক পরিষেবায় নিযুক্ত কর্মীগণ কাজ করিবেন। আনন্দযজ্ঞে তাঁহাদেরও নিমন্ত্রণ আছে, কিন্তু তাই বলিয়া কর্তব্য অবহেলা করিবার প্রশ্ন নাই। সুতরাং, এই কর্ম-যোগ! এই দৃষ্টান্তটি তাৎপর্যপূর্ণ হইয়া উঠে সাম্প্রতিক অন্য একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে। ষান্মাসিক ব্যাঙ্ক-বন্ধের দিন এবং দুর্গোৎসবের জোয়ারে কার্যত টানা প্রায় ছয়টি দিন ব্যাঙ্ক-এর কাজকর্ম ব্যাহত হইবার উপক্রম। শারদীয় আনন্দে ব্যাঙ্ক-কর্মীদের যোগ দিবার অধিকারটিকে সম্মান জানাইয়াও বলা চলে, বিষয়টি অস্বাভাবিক। কারণ, বর্তমানে ব্যাঙ্কের পরিষেবা নিশ্চিত রূপেই অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার অঙ্গ। শারদীয় উৎসব উপলক্ষে সেই কাজকর্ম টানা ছয় দিন বন্ধ থাকিবে, তাহা বাঞ্ছনীয় নহে।
তর্ক উঠিবে, এ টি এম-গুলি কাজ করিবে, কোনও কারণে অর্থের প্রয়োজন হইলে গ্রাহকগণ এ টি এম হইতেই স্বচ্ছন্দে টাকা তুলিতে পারিবেন। এমনও হয়তো বলা যায় যে উন্নত পশ্চিম দুনিয়াতেও ‘ক্রিসমাস’-এর সময় টানা বেশ কয়েক দিন এই জাতীয় সমস্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে, তাহা হইলে দুর্গাপূজার সময় ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকিলে কী ক্ষতি? কথাগুলি সত্য, তবে সত্যের অর্ধাংশমাত্র। বাকি সত্যটি ইহাই যে এখনও এই দেশের এবং এই রাজ্যের সমস্ত ব্যাঙ্ক-গ্রাহকদের একটি বড় অংশ সরাসরি ব্যাঙ্ক-এ গিয়া টাকা তোলা বা জমা দেওয়াই পছন্দ করেন। এ টি এম-এর প্রয়োগে স্বচ্ছন্দ, এই জাতীয় মানুষের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত মূলত শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ, নগরসীমা ছাড়াইলে এ টি এম-ও যত্রতত্র মিলে এমন নহে, তাহার ব্যবহারকারীর সংখ্যাও কমিয়া যায়। ব্যাঙ্ক-গ্রাহকগণের এমন মানুষ অজস্র মিলিবে যাঁহারা এখনও অসহায় রূপে অ-যান্ত্রিক, এ টি এম-এর চাবি টিপিবার পরিবর্তে ব্যাঙ্কে যাইলেই স্বস্তির শ্বাস ফেলিয়া থাকেন। পশ্চিমি দুনিয়ার চালটি এই রূপ নহে। সুতরাং ব্যাঙ্ক বন্ধ রাখিবার দাওয়াই চালু এ টি এম দিয়া দেওয়া চলিবে কি না, সেই বিষয়ে সংশয় বিস্তর। আরও মূলগত একটি সংশয় বিদ্যমান। অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার যথার্থ তাৎপর্যটি কি এই নাগরিক সমাজ অনুধাবন করিতে পারিয়াছে? ইহা যে নিছকই ছুটি বিসর্জন (এবং তৎসংক্রান্ত বিলাপ) নহে, ইহা পেশার দাবি এবং পেশাদারের ন্যায় তাহা পালন করা জরুরি, সেই বোধটি জাগ্রত হওয়া দরকার। অন্যথায়, সম্পূর্ণ কাজের প্রক্রিয়াটিই নিষ্প্রাণ হইয়া পড়িবে। |