ইউরোপীয় ইউনিয়ন নামক সংগঠনটির ভবিষ্যৎ কী, সেই প্রশ্নের উত্তরে এখনও বিস্তর ধোঁয়াশা। গ্রিস, আয়ার্ল্যান্ড, ইতালির ন্যায় দেশগুলি আর্থিক সংকটে পথ হারাইয়াছে। অন্য দিকে, এই দেশগুলিকে উদ্ধারের প্রকল্পে কত দূর যাওয়া উচিত, সেই প্রশ্নের যথার্থ উত্তরের খোঁজে জার্মানি বা ফ্রান্সের ন্যায় অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যসম্পন্ন দেশগুলির নেতারা নাজেহাল। এই সংকট গোড়ায় গলদের ফল ১৭টি দেশের আর্থিক সংগঠন তৈরি হইয়াছে, অথচ কোনও অভিন্ন রাজস্ববিধি নাই! এই সমস্যার সমাধানে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ছয়টি নিয়ম পাশ করিবার পক্ষে ভোট দিল। নিয়মগুলিকে একত্রে ‘সিক্স প্যাক’ বলা হইতেছে। এত দিন যে ‘গ্রোথ অ্যান্ড স্টেবিলিটি প্যাক্ট’ অনুসারে ইউরো অঞ্চলের আর্থিক নীতি নির্ধারিত হইত, ‘সিক্স প্যাক’ তাহারই মার্জিত রূপ। এই দফায় নিয়মগুলির উদ্দেশ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলির জন্য একটি অভিন্ন রাজস্ববিধি চালু করা। অর্থাৎ, কোনও একটি বা দুইটি দেশে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ লাগামছাড়া হইবে, তাহা রোধ করিবার প্রচেষ্টা। কোনও দেশ আর্থিক বিপদের সম্মুখীন হইতে চলিতেছে কি না, সেই বার্তা দিবারও ব্যবস্থা হইল। একই সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকারও ব্রাসেলস-এর হাতে থাকিবে। সিক্স প্যাক-এর মাহাত্ম্য, শাস্তির ব্যবস্থাও হইতেছে। যে দেশ ইউনিয়নের নিয়ম ভাঙিবে, তাহাকে দেশের জাতীয় আয়ের ০.২ শতাংশ ইউরোপীয় ব্যাঙ্কে জমা রাখিতে হইবে। তাহার পর, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভ্রান্তি সংশোধন না করিতে পারিলে সেই টাকা জরিমানা হিসাবে কাটিয়া লওয়া হইবে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট জানাইয়াছে, আইনটি ধাপে ধাপে প্রবর্তিত হইবে। ‘সিক্স প্যাক’ এক ঐতিহাসিক ভুল সংশোধনের প্রচেষ্টা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন গঠিত হয়, তখন অভিন্ন রাজস্ব নীতির কথা তেমন গুরুত্ব দিয়া ভাবা হয় নাই। তাহার ফল বিষম হইয়াছে। গ্রিসের ন্যায় দেশ, যেখানে অর্থনৈতিক কুশলতার মান নিচু এবং উৎপাদনশীলতা কম, তাহাদের পক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তি ঋণ পাওয়ার পথকে সুগম করিয়াছে। ফলে, ঋণ করিয়া ঘৃত পান করিবার প্রক্রিয়াটি পুরো মাত্রায় চলিয়াছে। তাহাতে শুধু এই দেশগুলির ক্ষতি, তাহা নহে গোটা ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়’ কাঠামোর ক্ষতি। আজ জার্মানি বা ফ্রান্সের ন্যায় দেশগুলি সেই ক্ষতির চরিত্র সম্যক বুঝিয়াছে। এখন পরিস্থিতি এমন যে গ্রিসকে ফেলাও সম্ভব হইতেছে না, আর বহন করাও ক্রমশ কঠিনতর হইতেছে। ইহা ঐতিহাসিক ভুলের মাসুল। ভবিষ্যতে যাহাতে ফের এই মাসুল না দিতে হয়, তাহার জন্য ‘সিক্স প্যাক’-এর সাফল্য অতি জরুরি। তবে, উল্লেখ করা প্রয়োজন, দায়ে পড়িয়া এখন অনেক দেশই রাজস্ব ঘাটতি কমাইবার কথা বলিতেছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী যেমন বলিয়াছেন, ২০১৩ সালের মধ্যে তাঁহার বাজেট ঘাটতিশূন্য হইবে। বাস্তবে তাহা হইবে কি না, তাহা পরের প্রশ্ন, কিন্তু চেষ্টাটি আন্তরিক হইলে ভাল। তবে, এই চেষ্টায় ভুলিলে চলিবে না যে অভিন্ন রাজস্ব নীতি ব্যতীত কোনও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো টিকিতে পারে না। ভারতের কথাই ধরা যাক। এই দেশের রাজ্যগুলির রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ যাহাতে একটি সীমার মধ্যে থাকে, তাহার জন্য ‘ফিসকাল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেটারি ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট’ পাশ হইয়াছে। কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, এই আইন সত্ত্বেও তো ভারতের এক একটি রাজ্যে রাজস্ব পরিস্থিতি এক এক রকম। এই প্রশ্নের দুইটি উত্তর হয়। এক, পরিস্থিতি পৃথক হইলেও আমূল ভিন্ন নহে জার্মানি ও গ্রিসের ব্যবধান ভারতের কোনও দুইটি রাজ্যের মধ্যে নাই। দুই, একটি সার্বভৌম দেশের হাতে ক্ষমতা অনেক বেশি। তাহার নিজস্ব আর্থিক নীতি থাকে, যাহা কোনও অঙ্গরাজ্যের থাকে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভবিষ্যতে কোন পথে যাইবে, সেই প্রশ্নের উত্তর অনেকাংশে ‘সিক্স প্যাক’-এর সাফল্যের উপর নির্ভর করিতেছে। তবে, ‘সিক্স প্যাক’ সহজে হয় না, বলিউডের নায়করা সাক্ষী। ব্রাসেলস আগে সর্বশক্তি প্রয়োগ করিয়া তাহা তৈরি করুক, তাহার পরই তাহার সার্থক
প্রয়োগ সম্ভব। |