কংক্রিটের পুজো মণ্ডপের মাঝখানে মাটির চাতালটা আজও নাড়া দেয় বাড়ির বর্তমান কর্তাকে। মনে পড়ে যায় ওই চাতালে পোঁতা যুপকাষ্ঠে বাঁধা সদ্যোজাত ছাগশিশুর কথা। মনে পড়ে বলির পরে ছটফট করছে ছাগশিশুটি। এবং তাকে ঘিরে ঢাকি, মানুষজনের পৈশাচিক নৃত্য। পরে ওই ছাগশিশুর রক্ত মাটির পাত্রে মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। দু’বছর ধরে আর এই দৃশ্যটা দেখতে হয় না ময়ূরেশ্বর থানার লোকপাড়া গ্রামের ঘোষ পরিবারের বর্তমান কর্তা, চিকিৎসক দুর্গাচরণ ঘোষকে।
তিনি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছেন বাপ-ঠাকুরদা প্রচলিত বলিদান প্রথা। এই প্রথা না থাকলেও বলির জন্য বরাদ্দ টাকা দরিদ্রনারায়ণ সেবায় লাগিয়েছেন তিনি। |
১৭৫ বছর আগে হীরালাল ঘোষ লোকপাড়ায় দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন। তিনি িছেন অপুত্রক। তাই পুজোর দায়িত্ব বর্তায় তাঁর ভাগ্নে মতিলাল ঘোষের উপরে। ওই পুজোই বর্তমানে ঘোষ পরিবারের পুজো হিসেব খ্যাত। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী সপ্তমী, সন্ধি ও নবমীতে বলির রীতি ছিল। বাংলা ১৪১৫ সালে বলিদান প্রথা বন্ধ করে দেন দুর্গাচরণবাবু। তিনি বলেন, “দীর্ঘ দিন ধরে বলিদানের দৃশ্য মনে পীড়া দিত। বাপ-ঠাকুরদার প্রচলিত প্রথা বলে উপেক্ষা করতে পারিনি। পরে পর্যালোচনা করে বুঝেছি মায়ের কাছে সব জীব সন্তান তুল্য। তাই বলি প্রথা তুলে দেওয়া হয়।”
এক সময় ঘোষ পরিবারের পুজো ছিল এলাকার আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। কচিকাঁচা থেকে সব বয়সের মানুষ মণ্ডপে ভিড় জমাতেন। ডুপির বাজনা ও শিউলি ফুলের ঝরে পড়া শব্দ জানান দিত পুজো আসছে। গ্রামাফোনে বাজত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ কিংবা হেমন্ত সন্ধ্যার সুরেলা কষ্ঠ। ঘোষ পরিবারের পুজোতেই এলাকার মানুষ প্রথম পেয়েছিলেন শহুরে সংস্কৃতির স্বাদ। ঘোষ পরিবারের ছেলেদের পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে মধ্যরাত পর্যন্ত মণ্ডপে ভিড় জমাতেন এলাকার মানুষজন। বিসর্জনের জন্য অঞ্জলি ঘোষ, নীলিমা পালদের চাঁদা তুলে শহর থেকে বাজি-পটকা আনতেন শিবপ্রসাদ ঘোষ, হীরেন্দ্রনাথ ঘোষরা।
কিন্তু সে সব আজ ইতিহাস। মণ্ডপের পাশে সেই শিউলি গাছটা নেই। গ্রামাফোনে মরচে জমেছে। তবে সেই সব দিনের কথা কল্যাণ ঘোষ, পার্থ ঘোষদের স্মৃতিতে আছে। |