|
|
|
|
|
|
|
টগর মল্লিকা |
জীবন ভৌমিক |
সকাল থেকে মা বলছে, ‘ওরে মলি রে! একটু পড়তে বোস, বইখাতা নিয়ে একটু বোস।’
রোদ বিছানো জানলার তাকে বসে তার বেবি পুতুলটার চুলের বিনুনি গুছিয়ে মলি বলল, ‘আমার পড়তে ভাল লাগে না, ইস্কুলে যেতে ভাল লাগে।’
খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে মলির বাবা হেসে ফেলে। বলে, ‘রোববার কি তোর জন্য স্কুল খোলা থাকবে নাকি?’ মলি কিছু বলে না। পুতুলে নিবিষ্ট মন তার।
মলি মানে আমাদের মল্লিকা। নার্সারি ছাড়িয়ে এখন কিন্ডার-টু। আর তাকে নিয়ে এই গল্প তার শুরুর সময়কাল গেল ডিসেম্বর। সবার মুখে তখন এক কথা, কী ঠান্ডাটাই না পড়ল! পাশের বাড়ির নীলু জেঠু মলির বাবাকে ডেকে বলে, ‘কালকে কত ছিল জানেন?’
কত?
ওপরে সতেরো, নীচে এগারো।
মলিও শুনল কথাটা। শুনে এক বার ওপরে তাকিয়ে পরে নীচেটা দেখল, কিছুই বুঝল না। পাশ থেকে কচি গলায় কে যেন বলল, কী বোকা তুমি মল্লিকা, আরে ওটা দিনরাতের তাপমাত্রা, ওপর-নীচে তাকিয়ে দেখার কিছু নয়। ‘আরে, এ তো টগরের গলা! এতক্ষণ ওর কথা মনেই পড়েনি। রাগ কোরো না টগর।’ এটুকু বলে জানলার তাকে পুতুলটা রেখে এক লাফে নীচে নেমে কলতলা হয়ে জানলার ওপারে বাগানে এল মলি।
বাগান বলতে ওদের শোবার ঘরের পুব দিক লাগোয়া এক চিলতে জায়গা। দু’দিন অন্তর ঘাস-আগাছায় ভরে যায়। লোক ডাকিয়ে সাফ করতে হয়। অথচ ফুল গাছ লাগালে বাঁচে না। মাটির দোষ। মলির বাবা তাই বিরক্ত হয়ে ওই এক ফালি জায়গা পুরোটাই বাঁধিয়ে নিয়েছে। মাঝখানটা সাদা, চার ধারে লাল সিমেন্ট। সার মেশানো ভাল মাটি ভরা কয়েকটা টব। বেলফুল, গাঁদা, নয়নতারা, লালঝাউ, এই সব। আর মলির বাবার খুব পছন্দ থোকা টগর। মস্ত গামলার মতো টবে অনেক মাটি ঢালিয়েছে। তাতে বসিয়েছে টগর চারা। সেই টগর এখন মলির মাথা সমান। তো এখন সকালের রোদ পড়েছে চার পাশে ছড়ানো ডালের শীতের বিবর্ণ পাতায়। মলির মনে হয়েছিল যেন দু’হাত বাড়িয়ে টগর তাকে কাছে আসতে বলছে। মলি টগর গাছটার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ায়। বলে, শীতে-ঠান্ডায় তোমার খুব কষ্ট টগর, তোমার পাতাগুলো হলদে হয়ে ঝরে পড়ছে। দাঁড়াও সন্ধেবেলায় আজ তোমায় একটা চাদর পরিয়ে দেব। |
|
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য |
টগর বলে, না মলি, না। তার দরকার নেই। শীতে আমার কষ্ট হয় না। আসলে এখন আমাদের পাতা ঝরিয়ে ফেলার সময়, নতুন পাতায় ভরিয়ে দেব বলে। তুমি আমাকে কত ভালবাস, মলি। আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু হলে, যেমন ভোরের বাতাস আমার বন্ধু।
বাতাস আবার কেমন বন্ধু!
ওরে বাবা, সে যে আমার প্রাণের বন্ধু। সে আমার কোলে এসে খানিক জিরিয়ে নেয়। বাতাস আমায় কত কিছুর কথা বলে...
কী কথা বলে? মলি জানতে চায়।
টগর বলে, ‘সে আমায় নদীর কথা বলে, মেঘের কথা বলে, কত দূর দেশের গল্প বলে।’
মলি বলে, ‘আমি তো তোমায় এদের কথা বলতে পারব না, কী করে বলব? তার চেয়ে আমি তোমায় পুষি বেড়ালের কথা বলব, কুকুর ছানার গল্প বলব, ইস্কুলের বন্ধুদের কথা বলব...
আর পড়াশোনার কথা? ওই দেখো তোমার মা আসছে।
মলি পেছন ফেরে। ‘এ বার তোর কান ধরে নিয়ে এসে পড়তে বসাব...’ মলির মা এই কথা বলতে বলতে সত্যি আসছে।
মলির বাবা বলে, ‘থাক না, এই কনকনে ঠান্ডায় ওখানে বসে রোদ পোহাচ্ছে, থাক না।’
মলির মা রেগে গিয়ে বলে, ‘থাক না, মানেটা কী? সেই থেকে ওই টগর গাছটার গায়ে হাত-মুখ বুলিয়ে করছেটা কী! ওই গাছটা তুলে ফেলে দিয়ো তো। ওতে কোনও দিন ফুল ফুটবে না। গাছওয়ালা তোমাকে ঠকিয়েছে। গরম গেল, বর্ষা গেল, ফুলে ভরে যাওয়ার কথা। ফুটেছে একটাও? তোমার থোকা টগর!’
মলির বাবা বলে, ‘সত্যি তাই। চৈত্র-বৈশাখে কত কুঁড়ি ফোটার কথা। বছরভর যত্ন করলাম, সার-মাটি দিলাম, পোকা মারার ওষুধ দিলাম। কিছুতেই কিছু হল না। ওটা তুলে ফেলে অন্য গাছ বসাব।’
টগরকে নিয়ে মা-বাবার এ সব কথাবার্তা মলি সব শুনল। মলি এখন ঘরে বসে বইখাতা খুলে বসেছে। কিন্তু মন নেই বইখাতায়। বাবার জন্য কষ্ট হয়। কত আদরের টগর গাছটা তার। অথচ ফুল হচ্ছে না বলে গাছটা তুলে ফেলে দেবে বলছে। মলির দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে আসে।
শীত চলে গেল। মলির বন্ধু টগরের সারা গায়ে সতেজ সবুজের উৎসব। মনখারাপ আর বিরক্তি নিয়ে মলির বাবা রোজ সকালে অন্য গাছগুলোর সঙ্গে টগর গাছটাতেও জল দেয়। পাতার ডগায় জল চিকচিক করে। আজ মলির বাবা দেখল, আগেও এমন দেখেছে, দশ-বারোটা কুঁড়ি আধ ফোটা হলদেটে হয়ে আছে। কালই সব ক’টা ঝরে যাবে ঠিক।
তো সে-দিন হয়েছে কী, দিন না রাত, রাত না ভোর, অতশত বলার দরকার নেই। মোট কথা, রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে মা-বাবার সঙ্গে গপ্পটপ্প করে মলি শুয়ে পড়েছে। মলিকে নিয়ে মলির মা পুব দিকের ঘরে পুবের জানলা লাগোয়া ডিভানে পুব দিকে মাথা দিয়ে শোয়। মলির মাথার কাছে টগর গাছ। মা যতক্ষণ আসেনি, ততক্ষণ মলি উপুড় হয়ে শুয়ে জানলার নেট তুলে হাত বাড়িয়ে টগর গাছটার ডালে-পাতায় হাত বুলিয়ে আপন মনে কত কথাই না বলেছে। বলতে বলতে এক সময় ‘গুড নাইট টগর’ বলে ঘুমিয়ে পড়েছে।
রোজ সকালে মলিকে অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করতে হয়। মায়ের হাঁকডাকেই মলির ঘুম ভাঙে। কিন্তু আজ মলি শুনল, উঠে পড়ো বন্ধু, চেয়ে দেখো মল্লিকা সারপ্রাইজ।
স্বপ্ন মনে হল মলির। সত্যিই তো, চেনা গলায় বলছে ভোর হয়েছে মলি, উঠে পড়ে আমার দিকে তাকাও, সারপ্রাইজ।
স্পষ্ট টগরের গলা। উঠে বসে মলি। মা তখনও ঘুমোচ্ছে পাশ ফিরে। খোলা জানলা দিয়ে মলি দেখে রাতের শেষে আনকো আলোয় ভোর হচ্ছে। ভোরের বাতাস খেলা করছে টগরের সঙ্গে। আর টগরের ডালের সোরজে পাতার ফাঁকে ফাঁকে থোকা থোকা বরফ সাদা ফুল। মলির চোখের সামনে তাদের শেষ পাপড়ি মেলছে। একটা-দুটো-তিনটে... দশটা। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে মলি। তাকিয়েই থাকে। হঠাৎই হুঁশ ফিরে আসে মলির। সে মাকে ডেকে তোলে, ‘উঠে পড়ো মা, বাবাকে ডাকো...’ বলতে বলতে বাগানে গিয়ে টগর গাছটার কাছে দাঁড়িয়ে; আনন্দে উত্তেজনায় মলির গলা কাঁপছে। মলি বলছে, ‘মা, এসো, দেখে যাও বাবা, টগরের সারপ্রাইজ দেখে যাও, আমার বন্ধু টগর।’
|
|
|
|
|
|