বিধানসভা ভোটের পরে চার মাস হয়ে গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে দলের জনসমর্থন একচুলও বাড়েনি। সে কথা প্রকারান্তরে মেনে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উপরেই ভরসা রাখছে দল। রাজ্য স্তরে এই ভাবে ফিরে আসার লড়াই শুরু করতে চাওয়ার পাশাপাশি প্রকাশ কারাটরা জাতীয় স্তরেও বাম মনোভাবাপন্ন দলগুলিকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার পথে এগোতে চাইছেন।
চার মাসের মধ্যে যে জনমতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে না, দুই কেন্দ্রে উপনির্বাচনের পরে এ কথা বলেছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। আজ কারাটও একই সুরে জানিয়েছেন, এমন কোনও পরিবর্তনের আশাও তাঁরা করেননি। তবে এর পাশাপাশি প্রকারান্তরে তিনি মেনে নেন, এর মধ্যে দলের জনসমর্থন একটুও বাড়েনি। বরং ভবানীপুরে ব্যবধান বাড়া ছাড়াও যে ভাবে চার মাস আগে জেতা বসিরহাট উত্তরের মতো আসন হারাতে হয়েছে, তাতে আগামী দিনে জনসমর্থন ফিরে পাওয়া বেশ কঠিন। আজ কারাট বলেন, “জনসমর্থনের ক্ষেত্রে এখনও কোনও পরিবর্তন হয়নি। অবশ্য চার মাসের মধ্যে আমরা বিরাট কোনও পরিবর্তন আশাও করিনি।”
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উপরই আস্থা রাখতে চাইছেন সিপিএম নেতৃত্ব। যদিও রাজ্যে মতাদর্শগত অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার পিছনে পলিটব্যুরোর একটি বড় অংশ এখনও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেই পরোক্ষে দায়ী করে থাকেন। বুদ্ধবাবু এ বারও শারীরিক অসুস্থতার কারণে পলিটব্যুরোর বৈঠকে যোগ দেননি। কিন্তু এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও আজ কারাট অবশ্য তা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, “বুদ্ধবাবুর শরীর খারাপ। তাই আসতে পারেননি। তবে বিভিন্ন সময়ে এই বৈঠক নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে। তিনি তাঁর মতামতও দিয়েছেন।” দলীয় সূত্রের খবর মতাদর্শগত নথি সম্পর্কে লিখিত ভাবে নিজের মতামত ইতিমধ্যেই পলিটব্যুরোকে জানিয়েছেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গে ঘর মেরামতের সঙ্গে সঙ্গে এ বার জাতীয় রাজনীতিতেও নজর দিতে চাইছেন সিপিএম নেতৃত্ব। এ দিন একাধারে কংগ্রেস এবং বিজেপি, দুই দলকেই বিদ্ধ করেছেন কারাট। এক দিকে তিনি যেমন চিদম্বরমের ইস্তফা চেয়েছেন, আক্রমণ করেছেন প্রধানমন্ত্রীকে বা মূল্যবৃদ্ধি প্রশ্নে ইউপিএ সরকারকে তুলোধোনা করেছেন, অন্য দিকে তেমনই বলেছেন, “এনডিএ সময়ে মূল্যবৃদ্ধি রুখতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তার ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।”
কারাট এ ভাবে দু’দলকে একযোগে আক্রমণ করায় অনেকেই মনে করছেন, আগামী লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে একটা বৃহত্তর বাম ঐক্য গড়ার পথে এগোচ্ছেন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক। যেখানে শুধু বামেরাই নয়, বামেদের মতো মনোভাবাপন্ন দলগুলিকেও একই ছাতার তলায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। তাই তামিলনাড়ুতে জয়ললিতা বা অন্ধ্রপ্রদেশে চন্দ্রবাবু নায়ডুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছে সিপিএম শিবির। যদিও জয়ললিতার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে এ দিন মুখ খুলতে চাননি কারাট। তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, “ওই রাজ্যে বিধানসভা ভোটে সমঝোতা হয়েছিল। অন্য কোনও বিষয়ে নয়।” তবে দলীয় সূত্রের খবর, আগামী লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ও বিজেপির বিরোধী জোটকে সঙ্গে নিয়ে ফের একটি বিকল্প সরকার গড়ার বিষয়ে ভিতরে ভিতরে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন সিপিএম নেতৃত্ব।
এ দিন অবশ্য কারাটের মূল আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন চিদম্বরম। এত দিন তাঁরা চিদম্বরমের ভূমিকা নিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি জানাচ্ছিলেন। কিন্তু এখন বিজেপি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছে দেখে পলিটব্যুরোর বৈঠকে নিজেদের অবস্থান বদলাতে বাধ্য হল সিপিএম। বৈঠকের পর দলের কারাট বলেন, “টু-জি স্পেকট্রাম বণ্টনে যে ভাবে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে, তাতে চিদম্বরম দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। প্রণববাবু বাধ্য হয়ে ‘চিদম্বরমের কোনও ভূমিকা নেই’ বললেও আমরা মনে করি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অবিলম্বে ইস্তফা দেওয়া উচিত।”
এ দিন প্রধানমন্ত্রীকেও নিশানা করেছেন কারাটরা। তাঁদের বক্তব্য, টু-জি বণ্টনে যে অনিয়ম হচ্ছে, ইউপিএ-র প্রথম জমানায় সে কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বারবার চিঠি লিখেছেন সীতারাম ইয়েচুরি। সেই সূত্র ধরে কারাট এ দিন বলেন, “প্রধানমন্ত্রী সব জানতেন। তিনি জেনেশুনে সব মেনে নিয়েছেন। সরকার কোনও ভাবেই নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না।”
টু-জি-এর দুর্নীতি ছাড়াও আজ মূল্যবৃদ্ধি প্রশ্নেও ইউপিএ সরকারের সমালোচনা করে পলিটব্যুরো। আলাদা ভাবে আক্রমণ করা হয় বিজেপিকেও। কিছু দিন আগে পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি প্রশ্নে বাম-বিজেপি একসঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল। কিন্তু এখন বিজেপির সঙ্গেও সচেতন ভাবে দূরত্ব তৈরি করতে চাইছে সিপিএম। দলের বক্তব্য, কংগ্রেস ও বিজেপি দু’দলের মধ্যে নীতিগত কোনও পার্থক্য নেই। তাই তারা দু’দলের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাবে। |